"ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম" বইটির প্রথম ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ মওলানা আবুল কালাম আজাদ শুধুই একজন ব্যক্তি নন, একটি প্রতিষ্ঠান। পারিবারিক কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বিশ্বাসের বলয় থেকে মুক্ত হয়ে তিনি ‘আজাদ’ ডাকনাম গ্রহণ করেন। ধর্মীয় ঐতিহ্যকে হৃদয়ে ও মননে ধারণ করেও এই মহান । মানুষটি মুক্তবুদ্ধির অগ্রণী এক পুরুষ হিসেবে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে। এই উপমহাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র এবং সমাজ গঠনের জন্য। ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’-এর ছত্রে ছত্রে রয়েছে তার দৃষ্টান্ত-এ গ্রন্থে বিষয়বস্তুর উপস্থাপন ও বিশ্লেষণের মধ্যে রয়েছে দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমে আপুত অথচ সংযত আবেগসম্পন্ন বুদ্ধিদীপ্ত একটি মানুষের আত্মজৈবনিক অভিব্যক্তি। ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন পাশ হওয়ার পর থেকে গান্ধীজির হত্যালগ্ন যদিও এ গ্রন্থটির সময়কাল, তবু ভারতবর্ষের আবহমান হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, ব্রিটিশ বিরােধী সংগ্রাম, দেশ-বিভাগের পটভূমি, এমনকি ভবিষ্যতকালে এই বিভাজনের পরিণতি সম্পর্কে তার গভীর অনুধাবন এক বৈশ্বিক ব্যঞ্জনায় ফুটে উঠেছে এর মধ্যে দিয়ে। অদ্ভুতভাবে মৃত্যুর কয়েক দশকের মধ্যেই তার অনেক ভবিষ্যত্বাণীর সত্যতা আমরা অনুধাবন করেছি। এ উপমহাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদের কালাে থাবা, ধর্মের নামে শােষণ-লুণ্ঠন ও সাম্রাজ্যবাদী শাসন, আর সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের কারণে অজস্র হানাহানি স্মরণ করিয়ে দেয়। মওলানা আজাদের অনেক সতর্কবাণী। আজো তাই এ গ্রন্থ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, আজো তা প্রতিটি সচেতন মানুষের জন্য অবশ্যপাঠ্য। এ গ্রন্থ মওলানা আজাদ এবং সে সঙ্গে এ উপমহাদেশের আরেকজন প্রতিভাবান ও হৃদয়বান মানুষ হুমায়ুন কবিরের (গ্রন্থের সম্পাদক) প্রেমময় শ্রমের ফসল। গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশের সময় তাদের প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন।
ভারতবর্ষের টানা প্রায় দুইশ বছরের রক্তাক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের পর ঘটনাবহুল সর্বশেষ সাতটি বছরের প্রধান রাজনৈতিক চরিত্ররূপেই নয় আরো অনেক কারণেও উপমহাদেশের অনন্য চরিত্র মাওলানা আবুল কালাম আজাদ (১৮৭৮-১৯৫৮)। তাঁর জন্ম পবিত্র মক্কায়। বেড়ে ওঠা ও লেখাপড়া কলকাতায় একান্তই ঘরোয়া পরিবেশে। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙিনা না মাড়িয়েও তিনি আধুনিক ও প্রাচীন শিক্ষার শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিতদের ওপর প্রাধান্য অর্জন করেছিলেন কেবল নিজের প্রখর প্রতিভাবলে। কি জ্ঞানবত্তায়, কি সাহিত্য ও সাংবাদিকতায়, কি রাজনীতি ও সংগঠনে সর্বত্রই তিনি একটি অদ্বিতীয় বিপ্লবী চরিত্র। মুসলিম সমাজের তিনি ‘ইমামুল হিন্দ’, হিন্দুপ্রধান ভারতীয় কংগ্রেসের তিনি বরেণ্য সভাপতি। ব্রিটিশ ভাইসরয় ও কূটনীতিকদের সাথে সংলাপে তিনি ছিলেন কংগ্রেসের একমাত্র প্রতিনিধি। তাঁর সম্পাদিত উর্দু সাপ্তাহিক আল-হেলাল-এর জন্য তাঁকে বারবার কারাগারে যেতে হয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও নীতিনিষ্ঠায় ভারতবর্ষের অন্য কোনো নেতাই তাঁর সমকক্ষ ছিলেন না । মি. জিন্নাহর পাকিস্তান দাবির সম্মুখে একে একে গান্ধী-নেহরু-প্যাটেল সকলেই নেতিয়ে পড়লেন, কিন্তু‘ তখনো তিনি তাঁর অবদানে অটল ছিলেন । অবশেষে স্বাধীন ভারতে যখন তিনি চরম সাম্প্রদায়িক রাজনীতির রূপায়ন দেখলেন, তখন তাঁর স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। এ পুস্তকটি তাঁর সে মর্মবেদনার মূর্তরূপ। এটাকে তাঁর দায়মোচনের প্রচেষ্টাও বলা চলে। রাজনীতিক মাওলানা আজাদের মৃত্যু হলেও যুগস্রষ্টা লেখক ও চিন্তাবিদ বিপ্লবী আজাদ যুগ যুগ ধরে অমর হয়ে থাকবেন।