বইয়ের ভেতর থেকে নির্বাচিত অংশ আজকের যুগে যেমন প্রতিটি আসরের জন্য স্বাগতিক নির্বাচন করা হয়, হাজার বছর আগে সেই ঝামেলা ছিল না। তখন অলিম্পিক ছিল শুধুই গ্রীকদের খেলা। ফলে স্বাগতিক দেশ সবসময়েই গ্রীস। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে এলিস। কারণ তাদের হাতেই ছিল অলিম্পিয়ার নিয়ন্ত্রণ। প্রথম অলিম্পিকের সময়কাল আগেই বলা হয়েছে, ৭৭৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। গবেষকরা এর আনুমানিক একটি তারিখও বের করেছেন। এটি হলো গ্রীষ্মের সবথেকে বড় দিনের (summer solstice) পরের প্রথম পূর্ণচন্দ্রে। সেই হিসেবে প্রাচীন অলিম্পিক আরম্ভ হয়েছিল গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে। এরপর থেকে প্রতি চার বছর অন্তর অন্তর হতে থাকে জনপ্রিয় এই আসর। প্রথম আসরের সময়কাল জুলাই ধরলেও পরের অনুষ্ঠানগুলি সম্ভবত আগস্টের ছয় থেকে সেপ্টেম্বরের উনিশ তারিখের মধ্যে পড়ত। অলিম্পিক এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল গ্রীকদের জন্য যে একে কেন্দ্র করে নতুন এক সময়ের এককের সূচনা হয়, অলিম্পিয়াড। দুই অলিম্পিকের মধ্যবর্তী চার বছর অলিম্পিয়াড নামে অভিহিত ছিল। আধুনিক অলিম্পিক কাগজে-কলমে শুরু হয়েছে ১৮৯৬ সাল থেকে। আর প্রাচীন অলিম্পিকসের খোঁজ জানতে ফিরে যেতে হবে খ্রিষ্টের জন্মের ৭৭৬ বছর আগে, যখন লিখিত রেকর্ডে এই আসর নথিভুক্ত হয়েছিল। তবে গ্রীক পুরানে অলিম্পিকের শুরু বহু আগেই। হোমারের কাহিনি ছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে গ্রীসে অনেক খেলাধুলার আসরের কথা এলেও অলিম্পিকই ছিল প্রধান। প্রাচীন গ্রীক কবি পিন্ডার দাবি করেছেন অলিম্পিকের আসর খেলাধুলার সবথেকে পুরাতন প্রতিযোগিতা, যার সূচনা জিউসপুত্র হেরাক্লসের হাত ধরে। দেবরাজ জিউস আর মর্ত্যমানবী অ্যাল্কমেনের সন্তান হেরাক্লসের বিখ্যাত বারোটি কাজের একটি ছিল এলিস রাজ্যের রাজা ইজিয়াসের আস্তাবল পরিষ্কার। ময়লার স্তূপ পরিষ্কার করতে হেরাক্লস পার্শ্ববর্তী নদীতে বাঁধ দিয়ে সমস্ত পানি আস্তাবল দিয়ে প্রবাহিত করেন। ফলে নিমেষেই ভোজবাজির মতো সব দাগ, ময়লা মুছে গেল! কিন্তু ইজিয়াস হেরাক্লসকে প্রাপ্য পারিশ্রমিক দিতে অস্বীকার করলে হেরাক্লস তাকে হত্যা করেন। এলিস লুণ্ঠন করে ধনরত্ন নিয়ে হেরাক্লস চলে গেলেন পিসা শহরে। এর নিকটেই অলিম্পিয়ার বনাঞ্চল, যার অবস্থান দক্ষিণ গ্রীসের পেলোপন্নেস পর্বতমালার পশ্চিম উপকূলে। হেরাক্লস সেখানে এক পবিত্র স্থান নির্ধারণ করলেন, নিজ হাতে লাগালেন জলপাই গাছ। এরপর পুরো জায়গা বেড়া দিয়ে ঘিরে এর বাইরে জাঁকজমকপূর্ণ আসর আয়োজন করলেন জিউসের সম্মানে। পিন্ডার দাবি করেন এভাবেই শুরু হয় অলিম্পিক। প্রতি চার বছর পর পর হওয়া এই আসরের অন্তর্ভুক্ত ছিল দৌড়, মুষ্টিযুদ্ধ, কুস্তি, বর্শা নিক্ষেপ, ডিস্কাস ছোড়ার মতো খেলা। সুবিখ্যাত গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডেটাসের বর্ণনাতেও উঠে এসেছে অলিম্পিকের কথা। তিনি জানিয়েছেন ৪৮০ খৃষ্টপূর্বাব্দের দিকে পারস্য সম্রাট জার্সেস যখন গ্রীস আক্রমণ করেন তখন চলছিল অলিম্পিক। আছে এক শহর আক্রমণ করতে গিয়ে সম্রাট শহরে অল্প কিছু লোক দেখতে পান। তিনি গ্রীকদের ধরে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে বাকিরা অলিম্পিকে অংশ নিচ্ছে। সম্রাট মনে করলেন নিশ্চয় জয়ী হলে বহু ধনরত্ন পাওয়া যাবে বলেই গ্রীকরা সেখানে গেছে। তিনি প্রশ্ন করলেন অলিম্পিকের পুরষ্কার কি? গ্রীকরা জবাব দিলো জলাপাইয়ের মুকুট। জার্সেসের জেনারেলরা আর্তনাদ করে নাকি বলে উঠেছিলেন আমাদের কোথায় নিয়ে এলেন যুদ্ধ করতে? এদের কাছে তো ধনসম্পদের থেকে সম্মান আর মর্যাদার অবস্থানই উঁচুতে। যেহেতু অলিম্পিকের পুরস্কার জয় যেকোনো নগর রাষ্ট্রের কাছে ছিল বহুল আকাঙ্ক্ষিত, ফলে তারা প্রতিযোগী নির্বাচনেও বেশ রক্ষণশীল ছিল। অলিম্পিককে সামনে রেখে প্রতিযোগীরা কঠোর প্রশিক্ষণে ডুবে যেত, যার তত্ত্বাবধান করতেন একজন অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক, যাকে গ্রীকরা বলত জিমন্যাস্ট (Gymnastes– আমরা জিমন্যাস্ট বলতে যা বুঝি তার থেকে ভিন্ন)। জিমন্যাস্টরা অনেক ক্ষেত্রেই ছিলেন প্রাক্তন অলিম্পিক বিজয়ী। তারা জানতেন কী করলে এবং কী খেলে মাংসপেশি আরও সবল হবে, শরীর প্রস্তুত হবে কঠিন প্রতিযোগিতার জন্য। প্রতিদিন দীর্ঘ সময় চলত ব্যয়াম, যার আগে ও পরে অ্যাথলেটদের গায়ে তেল মাখিয়ে দেয়ার জন্য আলাদা লোক নিযুক্ত ছিল। আসরের অন্তত এক মাস আগে থেকেই প্রতিযোগীরা অলিম্পিয়াতে উপস্থিত হতে শুরু করতেন। তাদের মুচলেকা দিতে হতো যে কমপক্ষে দশমাস তারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তারপরেই সুযোগ মিলত আসরে নামার। দৌড়ের দৈর্ঘ্য ঠিক হয়েছে এক স্টাড (Stade, বর্তমান স্টেডিয়াম শব্দের পূর্বপুরুষ)। আমাদের মাপে তা প্রায় ১৯২ মিটার, ৬০০ ফুটের কিছু বেশি। সবাইকে হারিয়ে বিজয়ী হলেন এলিস নগর রাষ্ট্রে বাবুর্চির কাজ করে জীবনধারণ করা এক ব্যক্তি, নাম তার করোবাস (Koroibos/Coroebus). উৎফুল্ল জনতা আনন্দে মেতে উঠল। বিচারকেরা তাকে পরিয়ে দিলেন হেরাক্লসের নিজের হাতে রোপণ করা জলপাই গাছের পাতার মালা আর মুকুট। প্রাচীন ইতিহাসের প্রথম অলিম্পিক বিজয়ী হিসেবে নাম উঠল করোবাসের। আরেকটু এগিয়ে চলে যাই ৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এক গ্রীষ্মে। আগস্টের কোনো এক বিকেলে মাঠে বসে খেলা দেখছেন ট্রাইফন আর রোডোন। দুজনেই পূর্ববর্তী অলিম্পিক বিজয়ী। স্টাডা দৌড়ে (১৯২ মিটার) বিজয়মাল্য ছিনিয়ে নিয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন তারা। প্রাচীন অলিম্পিকে মোট চার স্টাডার দৌড় হতো। ১৯২ মিটার ছিল স্বল্প দৈর্ঘ্য, ২ স্টাডা বা ৩৮৪ মিটার মধ্যম, আর ৭-২৪ স্টাডা, বা ১৩৪৪ থেকে ৪৬০৮ মিটারের দুটি দৌড় ছিল লম্বা দৈর্ঘ্যের। এগুলি অনুষ্ঠিত হতো একইদিনে। বর্তমান তুরস্কের দক্ষিণ পশ্চিমের কারিয়া শহরের এক যুবক পলাইটস (Polites) রোডন আর ট্রাইফনের বাজি। উত্তেজিত হয়ে দৌড় দেখছেন তারা। কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে পলাইটস। সেদিন সকালেই লম্বা দৈর্ঘ্যের দৌড় জিতে কিছুটা ক্লান্ত মনে হচ্ছে তাঁকে। ‘পারবে না, পারবে না!’ আফসোস করে উঠলেন ট্রাইফন। ‘সকালের শক্তির ছিটেফোঁটা তার মাঝে আর নেই!’ দ্বিমত পোষণ করলেন রোডোন, ‘না! না! দেখ, ও অন্য প্রতিযোগীদের ধরে ফেলছে কিন্তু!’ ঠিকই সবাইকে পাশ কাটিয়ে সমাপ্তির দাগ পার হয়ে গেল পলাইটস। একইদিনে স্বল্প আর লম্বা দৈর্ঘ্যের দৌড় জেতার এই কীর্তি আর কখনো কেউ করে দেখাতে পারেননি। সম্ভবত প্রাচীন অলিম্পিকের সবথেকে সহিংস খেলা ছিল প্যাঙ্ক্রেশন। এখানে চলত সবকিছু, কুস্তি, মুষ্টিযুদ্ধ, হাত-পা ভাঙা ইত্যাদি। নিষেধ শুধু কামড় আর চোখ তোলায়। এসব খেলা ছিল ক্ষণস্থায়ী, সম্ভবত ত্রিশ সেকেন্ড বা আরও কম। তবে কখনও কখনও মিনিটখানেকেও গড়াতে পারত। প্রাচীন এক শিল্পকর্মে দেখা গেছে প্যাঙ্ক্রেশনে এক প্রতিযোগী তার প্রতিপক্ষকে মাটিতে ফেলে চেপে ধরেছেন। প্রতিপক্ষের মুখে হাত দিয়ে বাধ্য করছেন তাকে শুধু নাক ব্যবহার করে শ্বাস নিতে। আবার অন্য হাত উপরে তুলে রেখেছেন এমন ভঙ্গিতে যে এটা পরিষ্কার যে তার পরবর্তী টার্গেট প্রতিপক্ষের নাক। প্যাঙ্ক্রেশনেও জয়ের নিয়ম ছিল একজনের আত্মসমর্পণ অথবা শারীরিকভাবে খেলা চালিয়ে যেতে অক্ষম হয়ে পড়া। একে অনেকটা আজকের দিনের ইউএফসি’র সাথে তুলনা করা যায়, যেখানে প্রতিপক্ষকে প্যাঁচে ফেলে হার স্বীকারে বাধ্য করা হয়। ইউএফসি’র খেলাগুলিও প্যাঙ্ক্রেশনের মতোই ক্ষণস্থায়ী। অভিজ্ঞ ফাইটাররা সাধারণত প্যাঁচে পড়লে দ্রুত হার স্বীকার করে নেন, যাতে দীর্ঘস্থায়ী ইনজুরি এড়ানো যায়। তবে প্রাচীন অলিম্পিকের প্রতিযোগীদের কাছে বিজয়ের মর্যাদা এতটাই ছিল যে তারা অনেক সময় হার স্বীকার করতে চাইতেন না, এতে জীবন বিপন্ন হয় তো হোক। এক্ষেত্রে সবথেকে বিখ্যাত হয়ে আছে অ্যারিকিয়ন (Arrichion) নামে এক গ্রীক অ্যাথলেটের নাম। দুইবারের অলিম্পিক প্যাঙ্ক্রেশন চ্যাম্পিয়ন অ্যারিকিয়ন ৫৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দেও ফাইনালে উঠেছেন। প্রতিপক্ষ তাকে মাটিতে ফেলে গলা চেপে ধরেছে, যাকে আমরা এখনকার দিনে চোক-হোল্ড বলে থাকি। অ্যারিকিয়ন দম নিতে পারছেন না, কিন্তু হার স্বীকার করতে রাজি নন তিনি। দম ফুরিয়ে যাওয়ার ঠিক আগে প্রতিপক্ষের পা গোড়ালি নাগালে পেয়ে ভেঙে দিলেন তিনি। তীব্র ব্যথায় প্রতিপক্ষ হার স্বীকার করে নিল। রেফারি অ্যারিকিয়নকে বিজয়ী ঘোষণা করলেন। কিন্তু তিনি ততক্ষণে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।