জাতি’ শব্দটার একটা সাধারণ সংজ্ঞা দেওয়া সহজ নয়। জাতিসংঘ (United Nations) গঠিত হয় ১৯৪৫ খৃস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর। শুরুতে এর সদস্য সংখ্যা ছিল ৫১। কিন্তু বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ১৯৩ টিতে। এদের প্রত্যেককেই ধরা হচ্ছে এক একটি জাতি। কিন্তু এদের অনেকেই একই ভাষায় কথা বলে। ভাষা জাতীয়তার একটি বিশেষ উপাদান। কিন্তু এখানে একই ভাষাভাষী মানুষ বিবেচিত হচ্ছে বিভিন্ন জাতি হিসাবে। আমরা বাংলায় জাতি শব্দটা ব্যবহার করছি ইংরেজি Nation শব্দটার প্রতিশব্দ হিসাবে। কিন্তু ইংরেজি ভাষাতেও Nation শব্দটি যে একটা সুনির্দিষ্ট অভিধা লাভ করতে পেরেছে, তা নয়। ইংরেজি ভাষায় Nation শব্দটি এসেছে ফরাসি ভাষার মাধ্যমে লাতিন ভাষা থেকে। লাতিন ভাষায় Natus শব্দটার মানে হচ্ছে একই পূর্ব পুরুষ থেকে উদ্ভুত জনসমষ্টি। আমাদের বাংলা ‘জাতি’ শব্দটাও জাত বা জন্মসূত্রে উদ্ভূত জনসমষ্টির ইঙ্গিতবহ। সাবেক পাকিস্তান রাষ্ট্রটি উদ্ভব হতে পেরেছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। ধরে নেওয়া হয়েছিল সারা বৃটিশ ভারতে মুসলমানরা হল একটি জাতি। এই জাতি চেতনার উদ্ভব হতে পেরেছিল বৃটিশ শাসনামলের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে। সাবেক পাকিস্তান ভেঙে গিয়েছে। কিন্তু তা বলে দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণা যে একেবারেই অতীতের ঘটনা হয়ে গিয়েছে, তা নয়। মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের মানুষ চাচ্ছে একটা পৃথক রাষ্ট্র হিসাবেই অধিষ্ঠিত থাকতে। এই বাস্তবতাকে বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে। আমাদের আলোচনা আরম্ভ হতে যাচ্ছে, ‘বাংলাদেশে ইসলাম’ নামক অধ্যায় দিয়ে। কারণ বর্তমান বাংলাদেশ সৃষ্টি হতে পেরেছে বাংলাভাষী মুসলমান থাকবারই কারণে। তারা না থাকলে নিশ্চয় বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রটা সৃষ্টি হতে পারত না। এটাকে ধরতে হয় একটা স্বতঃসিদ্ধ হিসাবে। বর্তমান বইটি লিখিত হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কিছু মৌলিক প্রসঙ্গ নিয়ে। এর জনসমষ্টির সমাজ সংস্কৃতি নিয়ে। এর লক্ষ্য হল বাংলাদেশকে জানা এবং বুঝা।
Abney Golam Samad ২৯ ডিসেম্বর ১৯২৯ সালে রাজশাহীতে জন্ম গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট প-িত, চিন্তাবিদ, বহুমাত্রিক লেখক এবং কলামিস্ট। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের একজন অধ্যাপক ছিলেন। পেশায় উদ্ভিদ বিজ্ঞানী হলেও ইতিহাস ও শিল্পকলায় তিনি বিশেষ আগ্রহী। এ সব বিষয়ে তাঁর লেখালিখি রয়েছে যা মননশীল বক্তব্যে ঋদ্ধ। পরিণত বয়সে কলম ধরে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে ইতিহাসের অমূল্য উপাদান সংরক্ষণ কওে চলেছেন। ১৯৪৮-এ শিক্ষা সংঘ বিষ্ণুপুর থেকে বি. কোর্স পাশ করেন যা তখনকার মাধ্যমিক সমমান পাশ ছিলো। এরপর তিনি রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৪৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। তেজগাঁও কৃষি ইনিস্টিটিউট থেকে কৃষিবিদ্যায় স্নাতক সম্পন্ন করার পওে তিনি বিলেতে পাড়ি জমান উদ্ভিদ রোগতত্ত্বের ওপরে গবেষণা করতে। ফ্রান্সে ৪ বছর গবেষণা করেন প্ল্যান্ট ভাইরাসের ওপরে। ১৯৬৩ সালে দেশে ফিরে ১৯৬৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এবনে গোলাম সামাদের পিতা মো.ইয়াসিন একজন স্টেশন মাস্টার ছিলেন। তাঁর মাতার নাম নছিরন নেসা। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ৪ ছেলে এবং ২ মেয়ের জনক। তিনি কলাম লেখক হিসেবে বাংলাদেশে সমাধিক পরিচিত। তিনি মূলত রাজনীতি-সমাজনীতি নিয়েই বেশি লিখতে পছন্দ করেন। ইনকিলাব, নয়াদিগন্ত এবং আমার দেশ পত্রিকার নিয়মিত কলাম লেখক হিসেবে কাজ করেছেন অনেক দিন। তাঁর লেখায় মুক্তচিন্তার ছাপ লক্ষ করা যায়। তাঁর লেখায় গভীর ইতিহাসচেতনারও ছাপ রয়েছে। দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজনৈতিক আনুগত্যেও অভাব তাঁর রচনাগুলোর বিশেষ আকর্ষণ। আছে এক ধরনের নৈর্ব্যক্তিকতা যা সচরাচর দেখা যায় না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আত্মজৈবনিক রচনা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য: ‘শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনী মনে হয়েছে একটি বহুগুণে গুরুত্বপূর্ণ রচনা। এতে ধরা পড়েছে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দর্শন। এখন আওয়ামী লীগের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে থাকা বামবুদ্ধিজীবীরা প্রমাণ করতে চাচ্ছেন যে, পাকিস্তান আন্দোলনটা ছিল একটি সা¤্রাজ্যবাদী চক্রান্ত। কিন্তু শেখ মুজিব তার জীবনীতে বলেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা।’ কলাম লেখা ছাড়াও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস ভিত্তিকপাঠ্য তালিকা এবং পাঠ্য তালিকার বাইরে তাঁর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই রয়েছে। তাঁর প্রকাশিত কিছু বইয়ের নাম উল্লেখ করা হলো: বাংলাদেশের আদিবাসী এবং জাতি ও উপজাতি, আত্মপক্ষ, আত্মপরিচয়ের সন্ধানে, বাংলাদেশ : সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি প্রতিক্রিয়া, মানুষ ও তার শিল্পকলা, নৃ-তত্ত্বের প্রথমপাঠ, প্রাথমিক জীবাণুতত্ত্ব, বায়ান্ন থেকে একাত্তর, আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা এবং আরাকান সংকট, ইসলামী শিল্পকলা, শিল্পকলার ইতিকথা, বাংলাদেশে ইসলাম ও ঐতিহ্য, বর্তমান বিশ্ব ও মার্কসবাদ, বাংলাদেশের মানুষ ও ঐতিহ্য, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব, জীবাণুতত্ত্ব, উদ্ভিদ সমীক্ষা, নৃ-তত্ত্ব।