“মাদক অপরাধ এবং এর দমন অন্য যেকোনো অপরাধ থেকে বহুলাংশে জটিল এবং যৌগিক প্রকৃতির। বাংলাদেশে মাদক অপরাধ দমনের মূল ভিত 'মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮' হলেও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে এ আইন বাংলাদেশের সংবিধান, মাদক বিষয়ক জাতিসংঘের কনভেনশনসমূহ, দণ্ডবিধি, ফৌজদারী কার্যবিধি, সাক্ষ্য আইন, মোবাইল কোর্ট আইন, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, এবং শিশু আইনের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। তদুপরি রয়েছে বৃটিশ আমল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রণীত ও জারিকৃত মাদক বিষয়ক বিভিন্ন বিধিমালা, ম্যানুয়াল, প্রজ্ঞাপন এবং সরকারি নির্দেশনা ও আদেশসমূহ। মাদক অপরাধ দমন কার্যক্রমে রেইড বা অভিযান পরিচালনা, কোথাও প্রবেশ বা তল্লাশি, কাউকে আটক বা গ্রেফতার, কোনো কিছু জব্দ বা আটক ইত্যাদি কার্যক্রমে উল্লিখিত এ সব আইন, বিধিমালা, প্রজ্ঞাপন, নির্দেশনা ও আদেশের সমন্বিত প্রয়োগ না হলে, কিংবা কোনো একটি আইন, বিধি, ম্যানুয়াল বা প্রজ্ঞাপনের কোনো একটি বিধান লঙ্ঘিত হলে কৃত কাজে আইনগত ভুল হতে পারে, কিংবা কাজটি বেআইনী হতে পরে, এতে আইনগত জটিলতা সৃষ্টি হতে পরে, এমন কি এর জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ এর ৩৯ ধারার বিধান মোতাবেক অভিযানকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উল্টো বেআইনী অভিযান, তল্লাশী, আটক, গ্রেফতার ইত্যাদির অভিযোগ উঠে তাকে বিচারের সম্মুখীন হওয়া লাগতেও পারে। বাস্তবতা হলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা এই সবগুলো আইন, বিধিমালা, ম্যানুয়াল, প্রজ্ঞাপন, নির্দেশনা বা আদেশের সব বিধানের খোঁজ একসাথে রাখেন না, কিংবা এতকিছু একসাথে সবার হাতের কাছে থাকেও না। ফলে মাদক অপরাধ দমনের সব কাজেই আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাকে প্রতি মুহূর্তে আইনগত বিপদে পড়ার সম্ভাবনা ও ঝুঁকি মাথায় নিয়ে কাজ করতে হয়। এই ঝুঁকি থেকে উত্তোরণের উপায় হলো কোনো একটি গ্রন্থের মধ্যে মাদক অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে দরকারি সব আইন, বিধি, ম্যানুয়াল, প্রজ্ঞাপনের বিধানাবলী যখন যেটুকু যেখানে যেভাবে প্রয়োগের জন্য দরকার সেভাবে একত্রে পাওয়া। এই প্রয়োজনের নিরিখে "মাদক অপরাধ দমন" গ্রন্থটি রচিত হয়েছে অপরাধ দমনের প্রতিটি বিষয়ে, প্রতিটি পরিস্থিতিতে ও প্রাসঙ্গিকতায় এই সবগুলো আইন, বিধিমালা, ম্যানুয়াল, প্রজ্ঞাপন, নির্দেশনা ও আদেশের সমন্বিত ও সুষম প্রয়োগ কিভাবে করতে হবে তার চুলচেরা ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণসহ। মাদক অপরাধ দমনের কাজ করতে হলে যেকোনো কর্মকর্তার জন্য মাদকের রাসায়নিক ও বৈজ্ঞানিক পরিচিতির তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকাসহ মাদক সমস্যার জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত, গভীরতা, ব্যাপ্তি ও স্বরূপ সম্পর্কে জানা দরকার। জানা দরকার বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে মাদকের চাষাবাদ, উৎপাদন, চোরাচালান, বিপণন ও ব্যবহার নিয়ে যে বিশাল অপরাধ সাম্রাজ্য ও ড্রাগ কার্টেলগুলোর অশুভ তৎপরতায় মানব সমাজ বিপন্ন তার ব্যাপ্তি ও গভীরতার প্রকৃতি সম্পর্কে। মাদক আটক করতে হলে আটককারী কর্মকর্তার জন্য মাদক চেনা ও শনাক্তকরণ দক্ষতা অপরিহার্য। মাদক অপরাধ দমন করতে হলে মাদক আইনে কোন কাজ কেন অপরাধ পদবাচ্য, আর কোন কাজ অপরাধ নয়-এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও স্বরূপ অনুসন্ধানসহ এর বিচার প্রক্রিয়া ও প্রতিটি অপরাধের ধারা এবং এর জন্য শাস্তির বিধান সম্পর্কে জানা আরো জরুরি। চোর ধরতে হলে চুরি বিদ্যায় পারদর্শিতার মতো মাদক চোরাচালান ডিটেক্ট করার জন্য চোরাচালান কেন হয়, এর ক্ষতিকর প্রভাব, চোরাচালানের আধুনিক প্রযুক্তি ও কলাকৌশল বিষয়ক জ্ঞান অর্জন অতি জরুরি। অভিনব ও অভাবনীয় সব পদ্ধতিতে চোরাচালানকৃত মাদক আটক ও উদ্ধার কাজে মাদক অপরাধ দমন কর্মকর্তার জন্য মাদক লুকানোর কলাকৌশল এবং তা খুঁজে বের করার জন্য তল্লাশির বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ও কলাকৌশলে বিশেষ দক্ষতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো এ বিষয়ে বিদ্যা অর্জনের জন্য কোনো বই নেই। মাদকের সঙ্গে সম্পর্কিত সাইবার ক্রাইম ও মাদক বিপণনের আধুনিক ও ভার্চুয়াল প্রযুক্তি, মাদক সংশ্লিষ্ট মানি লন্ডরিং-এর বিভিন্ন টেকনিক ও তা প্রতিহত করার জন্য স্পেশালাইজড্ ফিন্যান্সিয়াল ইনভেস্টিগেশন, ফরেনসিক ইনভেস্টিগেশন, কন্সপিরেসি ইনভেস্টিগেশন, মানি লন্ডারিং ইনভেস্টিগেশন, রিমান্ড, ইন্টারোগেশনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, মাদক বিপণনে সম্পৃক্ত সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন, মাদক অপরাধ দমনে আন্ডার কভার অপারেশন টেকনিক, কন্ট্রোল্ড ভেলিভারি টেকনিক, মাদক কারবারীর অর্থ-সম্পদ চিহ্নিত ও তা খুঁজে বের করার প্রযুক্তি এবং সেগুলো বাজেয়াপ্ত করা, মাদক অপরাধ দমনে কোন সংস্থাকে আইন কি ক্ষমতা কতটুকু কিভাবে দিয়েছে এবং এসব ক্ষমতার অপব্যবহার ও সীমা লঙ্ঘন হয় কিভাবে তা জানা, মাদক অপরাধ দমনের প্লানিং, রেইডিং টিম গঠন, অপরাধ দমন অভিযানের প্রস্তুতি, এর জন্য কি কি সাজ-সরঞ্জাম লাগে, রেইড এক্সিকিউশনের প্রযুক্তি ও কলাকৌশল, তল্লাশির আইন ও বিজ্ঞানভিত্তিক প্রযুক্তি, পদ্ধতি ও কলাকৌশল, খোলা স্থান, ঘরবাড়ি, বিভিন্ন ধরনের জল স্থল ও আকাশ যান তল্লাশির প্রযুক্তি ও কৌশলগত দিক, আটক ও গ্রেফতারের বিভিন্ন আইনগত বিধান, জব্দকৃত আলামতের সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ইত্যাদি বহু বিষয়ে আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেশীয় আইনের বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এই যে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে এসব বিষয়ের অনেক কিছুর উল্লেখ থাকলেও তার প্রয়োগ বা বাস্তবায়নের জন্য এখনো কোনো ম্যানুয়াল বা গাইডলাইন প্রণীত হয় নি। একশো বছর আগে বৃটিশদের প্রণীত রুলস ও ম্যানুয়ালের অধিকাংশ বিষয়ই বর্তমানের আল্ট্রামডার্ণ প্রযুক্তি-সমৃদ্ধ মাদক অপরাধ দমনে প্রয়োগোপযোগী নয়। "মাদক অপরাধ দমন" গ্রন্থটি বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ উন্নত দেশে মাদক অপরাধ দমনে অনুসৃত নানান বৈজ্ঞানিক পন্থার যতটুকু আমাদের আইনের সাথে খাপ খায়, ততটুকু আমাদের দেশে প্রয়োগোপযোগী করে গ্রহণ করা হয়েছে। এই গ্রন্থের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এখানে অপরাধ দমন, গোয়েন্দা কার্যক্রম, তদন্ত ও সাক্ষ্যের উপর খুঁটিনাটি সব বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের দণ্ডবিধি, ফৌজদারী কার্যবিধি, সাক্ষ্য আইন, মোবাইল কোর্ট আইন, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, এবং শিশু আইনের সাথে বিজ্ঞান ও উন্নত বিশ্বে প্রচলিত সব বিধি বিধান ও পদ্ধতির সমন্বয় সাধন করে এতো বিস্তৃত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সন্নিবেশ করা হয়েছে যা আর কোথাও নেই। ৮৮৮ পৃষ্ঠার ডিকশনারি আকৃতির বিশাল এ গ্রন্থে মাদক অপরাধ দমনের সমগ্র বিষয়কে একটি গ্রন্থের একটি কলেবরে ধারণ করতে গিয়ে এখানে এতো বেশি বিষয়ের সমাবেশ ঘটেছে যে এগুলোর সূচিপত্র তৈরি করতে গিয়েই শুধু ৪২ পৃষ্ঠা ব্যয় করতে হয়েছে। শুধু সূচিপত্র দেখেই বুঝা যাবে এ গ্রন্থ কত বেশি তথ্য-সমৃদ্ধ। এ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে ১৮৭ পৃষ্ঠাব্যাপী মাদক, মাদক শনাক্তকরণ এবং মাদকের জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও গতি প্রকৃতির আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ১৭১ পৃষ্ঠা ব্যাপী বিভিন্ন ধরনের মাদক অপরাধের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, তৃতীয় অধ্যায়ে ১৯৭ পৃষ্ঠা ব্যাপী মাদক গোয়েন্দা কার্যক্রমে অনুসৃতব্য বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পন্থা ও প্রযুক্তি, চতুর্থ অধ্যায়ে ১৫৪ পৃষ্ঠা ব্যাপী মাদক অপরাধ দমনের নানান পথ-পদ্ধতি ও প্রযুক্তি, পঞ্চম অধ্যায়ে ১৩২ পৃষ্ঠাব্যাপী শুধু মাদক অপরাধ তদন্তের নানান খুঁটিনাটি বিষয়ের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং ষষ্ঠ অধ্যায়ে ২২ পৃষ্ঠাব্যাপী সাক্ষ্য আইনের আলোকে মাদক অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় নানা ধরনের সাক্ষ্য প্রমাণ নিয়ে আলোচনা সন্নিবেশ করা হয়েছে। বিষয় ভিত্তিক বিবেচনায় এ গ্রন্থটি আসলে মাদক অপরাধ দমন বিষয়ক ৬টি পৃথক গ্রন্থের একটি একক সংকলন হওয়াতে এর কলেবর যে কেবল ডিকশনারির মতো এতো বিশাল হয়েছে তাই নয়, একে মাদক অপরাধ দমনের এনসাইক্লোপিডিয়া কিংবা ডিকশনারি বললেও বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। আমি লেখক হিসেবে নয়, একজন পাঠক হিসেবে খুব জোর দিয়ে বলবো যে মাদক অপরাধ দমন কাজে নিয়োজিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, পুলিশ, RAB, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, কাস্টমস্ ইত্যাদি সব সংস্থার কর্মকর্তা কর্মচারিদের জন্য এ গ্রন্থটি অবশ্যই পঠিতব্য ও অনুসরণীয়।” মোহাম্মদ আবু তালেব।