রাত্রি ঘনিয়ে এল। একটু একটু করে আশ্রমের সামনের রাস্তাটা অন্ধকারে ডুবে গেল। সারাদিন লোক এসেছে, গেছে। বনের মধ্যে দিয়ে এই পথ চলে গেছে অনেক দূরে। দুটো রাজ্যের মধ্যবর্তী এই বনাঞ্চল। তাদের রাজধানী দুটোকে জুড়ে রেখেছে এই পথ । দুটো রাজ্যই কৌরবদের তাঁবেদার। তাদের হুকুমে ওঠে-বসে। বনের সীমান্ত অবধি সাধারণের ব্যবহারের জন্য। কিন্তু বনের ভিতরের এই রাস্তা সকলের জন্যে নয়। সাধারণ ভাবে রাজবংশীয়দের মৃগয়ার জন্য ব্যবহার হয়। আর এই পথ ধরেই কাঠুরের দল, ব্যবসায়ীর দল আসে বনের ভিতর। কাঠ এখন খুব দামি বস্তু। দিকে দিকে যেন নগর নির্মাণের ধুম পড়ে গেছে। কাঠের নগর সব। তার চারদিকের প্রাকারও আজকাল পারলে কাঠ দিয়েই বানাবে সবাই। ভারতবর্ষ চোখের সামনে পালটে যাচ্ছে। আগেকার কালে সকলে চেষ্টা করত পাথর দিয়ে নগর বানাবার। এখন চাইছে কাঠ। সকলে বুঝবেন না কারণটা। পাথরের নগর বানাবার জন্য পাথর লাগে। এবারে যে অঞ্চল পাহাড়ি বা পাথুরে অন্তত সেখানে অসুবিধা কম, কিন্তু যেখানে পাহাড়ের চিহ্নমাত্র নেই সেখানে? সেখানে পাথর আনার যা খরচ তা কে দেবে? রাজা বলতে যারা, ধনবান বলতে যারা, তারা কেউই এত ধনীও নয় । আর একজন-দুজন নগর নির্মাণ করে থাকতে যাবে কেন? অনেকের থাকার নগরও অনেকের সামর্থ্যের মধ্যেই থাকা দরকার। সেই জন্যেই চাই কাঠের নগর। এতে বড়োলোকের বিলাসিতার অনুকরণ করাও যাবে আবার সেই সঙ্গে খরচটাও কমবে। তা ছাড়া বেশিদিন একই ধরনের গৃহ বা গৃহসজ্জা আজকাল অচল। এতে করে সময়ে সময়ে সে-সজ্জা বদল করে নেওয়া যায় । এর আর-একটা মানে আছে। গ্রামের জীবন থেকে অনেক মানুষ এবারে শহরে এসে জমছে। এটাও খেয়াল করার মতো বিষয়। তাই একটা নগর প্রতিষ্ঠা শেষ হতে না হতেই আর-একটা নগরের ভিত খোঁড়া হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে এই গঙ্গা-যমুনা-দোয়াব অঞ্চলে তো নগরের সারি লেগেছে যেন! দুটো নদীর যে-কোনোটারই বুকের উপর দিয়ে ভেসে যেতে যেতে দেখা যায় একটি নগর সীমা শেষ হতে না হতেই যেন আর একটা প্রায় শুরু হয়ে গেল। সেই নগরগুলো গড়ে তোলার জন্যে লাগে কাঠ। সেই কাঠের জন্যে বন উজাড় হচ্ছে। রাজার কোষাগারে অর্থের সংস্থান বাড়ছে।