ফ্ল্যাপে লিখা কথা ‘গাঙ পাড়ে’র জসীম উদ্দীন লেখেন-‘ঝড় আসে তো আসুক তোমার তুফানে কি ডর,/ জিল্কি ঠাঠা সাথের সাথী পদ্মাতে যার ঘর’। এর আগে নক্সী কাঁথার মাঠে’ তিনি এঁকেছেন পদ্মাপাড়ের লৌকিক ছবি যেখানটায় রূপ পেয়েছে অন্তরের সৌন্দর্য। বর্তমান গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন শিরোনামের কবিতায় ছড়িয়ে দিয়েছেন উদ্দীপনার সুর। অবশ্যই এই রূপারোপ গাঙ তীরবর্তী সরল মানুষকে উৎসর্গীকৃত । শুধুমাত্র গ্রামীণ অনুষঙ্গের প্রতি তীব্র আকর্ষণেই সমাপ্তি নয়- এই দরদী শিল্পী তৈরি করেন নিজস্ব বাক্ভঙ্গী এভং কথার যাদু। পাশাপাশি নিপীড়তের জন্যও শুনি তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ‘কোথায় কাঁদে উৎপীড়িত/ কোথায় ব্যথাতুর।’ ফাঁকে ফাঁকে কবিমানসের প্রকৃতি প্রেম ধরা পড়ে এভাবে- ‘বাঁকিয়ে দূরে আকাশ তীর/ কে ছুঁড়িয়া মেঘের নীড়।’ বিষয়বিন্যাসেও উঠে এসেছে অপার বৈচিত্র্য । যেমন ‘হাসু মিয়ার পাঠশালা’তে তিনি স্বপ্ন দেখেন এমন একটি শিক্ষালয়ের যেকানে ক খ গ ঘ ঙ ঝোলে আম গাছে এবং চ ছ জ ঝ ঞ জাম গাছে। শেষাবধি ‘গাঙ পাড়’ কবিতা হয়েও মাত্রা পায় জাগরণের গান হিসেবে।
গ্রন্থটির পরিশেষে সংকলিত জারী গান। জসীম উদ্দীন মৌলিক লেখনীর বাইরেও গ্রামে-গঞ্জে মানুষের মুখে মুখে আহরিত সোনালি সম্পদ উদ্ধারের কাজটি করে গেছেন নিভৃতে। বিপুল সেই সংগ্রহশালা। বাউল,মুর্শিদা, জারী, সারী, রাখালী, প্রতিটি ভাগে তাঁর হাত। আফাজউদ্দিন বয়াতীর কণ্ঠে শ্রুত ‘কোরবানীর জারী’ মূলত হযরত ইব্রাহিম এর আত্নত্যাগের কাহিনী। খঞ্জনীর সুরে সুরে বাংলার পল্লীগুলোতে এমন কত না কাহিনী গীত হচ্ছে। এক্ষেত্রে পল্লীকবি প্রয়োজনীয় সম্পাদনা দিয়ে জারী গানটিকে বাঁধলেন অক্ষরে বাঁধনে। শুধু আবেদনের কারণে নয়, রচনাটি থেকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও একটি ধারাবাহিকতা খুঁজে পাবে।
কবি জসীম উদ্দীন ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পার্শ্ববর্তী গোবিন্দপুর গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে তাঁর শৈশব কাটে। তাঁর পিতা আনসার উদ্দীন সেখানে একজন স্কুল শিক্ষক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তিনি এলাকায় প্রেসিডেন্টও ছিলেন। কবির মাতা রাঙাছুটু ছিলেন একনজন গৃহবধূ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রী অধ্যয়নকালে ও লাভের পর জসীম উদ্দীন প্রখ্যাত পণ্ডিত ড. দীনেশচন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে ‘রিসার্চ ফেলো’ পদে কর্মরত ছিলেন । দীনেশ সেন সেই দিনগুলোতে বাংলাদেশের বিভিন্ন পল্লী এলাকার মানুষের মুখে গীত-পঠিত পুথি সংগ্রহ ও গবেষণা করতেন । ড. সেন তার উপযুক্ত শিষ্য জসীম উদ্দীনকে বাংলার জেলাগুলোর বিশেষভাবে ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ জেলার সেইসব পুঁথি (কাব্য-লোকগাথা) সংগ্রহের দায়িত্ব দেন। জসীম উদদীন পুথি সংগ্ৰহকালে গ্রামীণ জনগণের আনন্দ-বেদনার কাব্যগাথার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন, মানুষকে ভালোবেসে একজন খাটি মানবপ্ৰেমী হয়ে ওঠেন। কবি পালাগান, গাজীর গান, জারীগান, লোকগীতির আসরে যেতেন, উপভোগ করতেন, মাঝে মাঝে নিজের বাড়িতেও লোকসঙ্গীতের আসরের আয়োজন করতেন । লোকগীতিতে সুরারোপ করেন ও বিশিষ্ট শিল্পীদের গান শেখান এবং পরবর্তীকালে কিছুকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন । লোকসংস্কৃতির উপাদান প্রত্যক্ষ করেন। জসীম উদদীন কবিতা, নাটক, উপন্যাস, কাব্যোপন্যাস, প্ৰবন্ধ, ত্য গবেষণাগ্রন্থ, গান, ভ্রমণকাহিনী এবং ও স্মৃতিকথাসহ অর্ধশতাধিক বইয়ের রচয়িতা। কবি দুইবার এডিনবাৰ্গ উৎসবে (১৯৫০ ও ১৯৬২ সালে) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভয়াসহ বহু দেশে অনেক লোকসংস্কৃতি উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর গ্রন্থগুলো বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে : ১৯৭০ সালে UNESCO তাঁর “সৌজন ব্যাদিয়ার ঘাট” ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ ও প্ৰকাশ করে । কবির ’মাটির কান্না’ কাব্যগ্রন্থটি রুশ ভাষায় একটি সংস্করণ বেরিয়েছে। ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ কবি ইহলোক ত্যাগ করেন ।