"আমি আমার মৃত্যুর পর স্বাধীনতা চাই না" বইয়ের ফ্ল্যাপের কথা পৃথিবীতে দাসব্যবসার অন্ধকার সময়ের কথা এখন আর কারও অজানা নেই। এশিয়া-আফ্রিকার নানা দেশ থেকে মানুষকে ধরে, কাজের লোভ দেখিয়ে এনে দাসের হাটে বিকিয়ে দেওয়া হত। জাহাজের খােলে কয়লার বস্তার মতাে মানুষ চালান দেওয়া নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক সাহিত্য। ক্রীতদাসদের মুক্তির জন্য আমেরিকায় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আব্রাহাম লিঙ্কন দাসপ্রথার বিলােপ করলেও আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ শ্বেতাঙ্গদের সমান অধিকার পায়নি আরও অনেকদিন পর্যন্ত। দাসত্বের অন্ধকারের পর এসেছে বর্ণবিদ্বেষের আঁধি। এই সমস্ত অত্যাচার, ঘৃণা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ফুসে ওঠা হৃদয়ের কথা বারবার লিখিত হয়েছে নানা গানে, কবিতায়। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে বিশিষ্ট আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ কবি পল লরেন্স ডানবার লিখেছেন“...আমাদের কান্না আর দীর্ঘশ্বাস গুনতে, পৃথিবীকে কেন হতে হবে অতি জ্ঞানী ?..”। ফেনটন জনসন লিখেছেন—“...সন্তানদের ছুড়ে ফেলে দাও নদীতে; এই সভ্যতা সন্তান দিয়েছে কাতারে কাতারে, মরে যেতে দাও ওদের—না হলে বড় হয়ে ওরা জানবে, ওরা কালারড!...” তবে শুধু প্রতিবাদের ভাষাই নয়। এই সংকলনের মাননীয় কবিরা রচনা করেছেন বিশুদ্ধ কাব্যরস রিতা ডাভ অনায়েসে লিখেছেন—“.ছেলেদের ঠোট কি নরম, শিশুর ত্বকের মতাে”।
আদিমকাল থেকেই মানুষ তার জৈবিক জীবন ছাড়িয়ে সৃষ্টিশীলতায় মেতেছে। এখানে শিক্ষা-অশিক্ষার প্রশ্ন অর্থহীন। অনুভূতির প্রকাশ লিখিত হওয়ার আগেও সৃষ্টির এক সুবিশাল পর্ব আছে। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গরাও তাদের প্রেম, বেদনা, সংগ্রাম ও মুক্তির কথা ছড়িয়ে দিয়েছেন গানে ও কবিতায়। প্রথমদিকের অসহায় আর্তনাদ-প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে, অধিকারবােধের মধ্যে দিয়ে, অবশেষে সূক্ষ্ম রসের গভীরে পৌছতে পেরেছে। এই সাধনার সঙ্গে বাংলার পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য এই সংকলন। আফ্রিকান-আমেরিকান কবিদের একশাে বছরের কবিতার একটি প্রতিনিধিত্বমূলক অনুবাদগ্রন্থ হয়ে রইল এ বই। কবি ল্যাংস্টন। হিউজেস-এর কবিতার একটি পংক্তি এই গ্রন্থের শিরােনাম। এই উচ্চারণে নিহিত আছে কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস। এ গ্রন্থের সম্পাদনা করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এ কাজে তাকে সহায়তা করেছেন গৌতম দত্ত ও অমিতাভ চৌধুরী।
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।