“রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা” বইয়ের প্রথম ফ্ল্যাপের কথা: এ -যুগের বাংলা সাহিত্যে আনকোরা স্বাদ যোজনা করল। এই গ্রন্থ। তিরিশ আর চল্লিশের দশকে পূর্ববঙ্গের একটি অঞ্চল— বরিশাল জেলা—আর কলকাতার ছাত্রজীবন এর পটভূমি। কিন্তু বিষয়বস্তু মামুলী অর্থে স্মৃতিচারণ বা সমাজচিত্র নয়, আত্মচারিত তো নয়ই। রচনাটির কেন্দ্রে রয়েছে এক বিচিত্র কৌতুকবোধ—গালগল্প, পরিবেশনের মধ্য দিয়ে যার অনবদ্য প্রকাশ। লেখায় বরিশালী সংস্কৃতি’র বলিষ্ঠ বিবরণও আছে, বহু ক্ষেত্রে ওই অঞ্চলেরই “দেবগন্ধৰ্ববিনিন্দিতা’ ভাষায়। কিছু-কিছু ক্ষেত্রে লেখক, কিন্তু সর্বত্র দিতে ভরসা করেননি। কারণ, তার ভাষায়, ‘সেন্সররা আপত্তি করতেন’। সংস্কৃত-ঘেঁষা গুরুগভীর শব্দের সঙ্গে বরিশালী ভাষা মিশিয়ে এক নতুন ও বিশেষভাবে স্বকীয় রচনাশৈলী সৃষ্টি করেছেন। এখানে সুরসিক লেখক। তার উপাদেয় ভঙ্গিতে একদিকে যেন হুতোমী, অন্যদিকে সৈয়দ মুজতবা আলীর অনন্য অনুরণন। শিক্ষিত, মার্জিত, বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরসে উজ্জ্বল চিরকালীন এ-গ্রন্থটিতে আমাদের সমাজ-জীবনের কিছু বিপর্যয়ের কথাও—যেমন, দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং দেশবিভাগ—এমনভাবে রয়েছে যে, আজকের জাতীয় সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে আরেক দিক থেকে তাৎপৰ্যময় হয়ে ওঠে এই বিবরণ। ১৯৯২ সালের শারদীয় ‘দেশ’-এ এ-লেখার কিছু অংশ প্রকাশিত হয়। প্রকাশের সঙ্গে-সঙ্গেই সর্বস্তরের পাঠকমহলে পায় বিপুল সমাদর ও সংবর্ধনা। বর্তমান গ্ৰন্থ সেই রচনারই পরিমার্জিত-পরিবর্ধিত সংস্করণ। একটি সম্পূর্ণ নতুন পরিচ্ছেদ এখানে যোগ করা হয়েছে। গ্রন্থটির এই দ্বিতীয় সংস্করণে পরিশিষ্ট রূপে যোগ করা হল লেখকের আরও কিছু রচনা, যা লেখকের ভাষায় ‘সমগ্র অপসংস্কৃতি সংগ্ৰহ।
দ্বিতীয় সংস্করণের নিবেদন: দ্বিতীয় সংস্করণ করার কারণ দুটি। প্রথম, রোমন্থনেরই সুরে ‘দেশ” এবং সানন্দা’য় চারটি ছ্যাবলা রচনা প্রকাশিত হয়। এ ধরণের অপসংস্কৃতি যাদের অপছন্দ নয়, ভাবলাম তাদের জন্য এ লেখাকটিও বইটার সঙ্গে জুড়ে দিই। গত ক’বছরে ইতিহাসভিত্তিক রচনা কিছু লিখেছি যা কেউ পড়েছে এমন প্রমাণ পাইনি। তবে ‘রোমন্থন” তথা ছ্যাবলা প্ৰবন্ধ পড়ে। কিন্তু অনেকেই মাঝে মাঝে পিঠ চাপড়ান। বলেন, “দাদা, আরও লিখুন।” আরও লেখা বোধ হয় হয়ে উঠবে না। যা লোকে পড়বে না, তারই আর কিছু লেখা বাকি আছে। তাই আমার “সমগ্র অপসংস্কৃতি সংগ্ৰহী” পাঠককে উপহার দিচ্ছি। দ্বিতীয় কারণ হল-“রোমস্থনের নায়ক বরিশাল তথা কীর্তিপাশা। আমার অনুজপ্রতিম মিহির সেনগুপ্ত বইটি পড়ে নাইয়া’ পত্রিকায় প্রচণ্ড বরিশালী ভাষায় ফাউল্কান অর্থাৎ উল্লাসে উল্লম্ফন করেন। তাঁর বক্তব্য আমার লেখাটি সম্বন্ধে বিশেষ ভাবে প্রাসঙ্গিক। পরে তিনি ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’ নামে অনেকাংশে বরিশালী জবানে বরিশাল-কীর্তিপাশা-রুণাসি নিয়ে একটি অসাধারণ গ্রন্থ রচনা করেন। বাঙালী মাত্রেই জানেন মানবজাতি দুই ভাগে বিভক্ত—Bengali আর non-Bengali তেমনি বরিশালবাসীর চোখে—জগত জুড়িয়া দুই জাতি আছেবরিশাইল্যা আর non-বরিশাইল্যা। তবে দ্বিতীয় জাতিটি ধর্তব্য নয়। NonBarisali পাঠকদের মিহিরের বইটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য নন্দন’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখি। যথাক্রমে মিহিরের এবং আমার এই দুটি লেখা বর্তমান সংস্করণে জুড়ে দেওয়া হল। আশা করি অপসংস্কৃতিপ্রিয় গৌড়জন নিরবধি না হলেও দু-চার মাস এই বন্দরস আনন্দে পান করবেন। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলি লেখকের পত্নী এবং তস্যা ভগিনী অতসী। কপি করে দিয়ে বিশেষ উপকার করেছেন, অতএব তারা ধন্যবাদাহঁ।
সূচীপত্র: * প্রারম্ভিক মুখব্যাদান ১১ * কথারম্ভ ১৫ * রোমাঞ্চক/রোমহর্ষক ইতিহাস ২৩ * নিজ মৌজা কীর্তিপাশা।। ২৮ * শাসন, শোষণ ও প্ৰজাপালন ৩৭ * জনৈক ব্ৰহ্মদৈত্য ও তার সহগামী কয়েকটি ভূত ৪৬ * শহর বইরশাল ৫৬ * ক্রান্তিকাল ৮০ পরিশিষ্ট ১। রোমন্থন প্রসঙ্গে: ক) আহ্রদে ফাউকানো অথবা ভাটিপুত্রর পত্র-বাখোয়াজি মিহির সেনগুপ্ত ১০৩ খ) অচেনা পিতৃভূমি, অজানা আত্মজন ১৩২ ২। অপসংস্কৃতিমূলক রচনা: ক) অথ। কারি-সংবাদ তথা বালতি-তত্ত্ব ১৩৯ খ) বুঝভুম্বুল ১৪৬ গ) হৃদয়বিদারক ১৫৩ ঘ) পরীক্ষা-নিরীক্ষা ১৫৯
Tapan Roychowdhury জন্ম ১৯২৬ সালে, পূর্ববঙ্গের কুমিল্লা শহরে। পৈতৃক ভিটে বরিশালের কীর্তিপাশা। শিক্ষা বরিশাল জেলা স্কুল, স্কটিশ চার্চ কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং অক্সফোর্ডের বেলিয়াল কলেজে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট. ডিগ্রি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় ইতিহাস ও সভ্যতার প্রাক্তন অধ্যাপক এবং সেন্ট অ্যান্টনিজ কলেজের প্রাক্তন ফেলো। প্রথম জীবনে পড়িয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তীকালে জাতীয় অভিলেখাগারের সহকারী অধ্যক্ষ, দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সের অধ্যক্ষ ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের অধ্যাপক পদে বৃত ছিলেন। এ ছাড়া হার্ভার্ড, পেনসিলভেনিয়া, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকো, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে অধ্যাপনা করেছেন। তার লেখা গ্ৰন্থ ইউরোপ রিকনসিডার্ড’ ১৯৮৭ সালে রবীন্দ্র পুরস্কার পায়। “রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্ৰাপ্তর পরিচারিতচর্চা” তার লেখা প্রথম বাংলা বই। কলকাতা, বর্ধমান, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি. লিট ও ভারত সরকার প্রদত্ত পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত ড. রায়চৌধুরী ভারতীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের অন্যতম খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞ।