“বাংলানামা” বইয়ের ফ্ল্যাপের কথা: আত্মকথা বা আত্মচারিত নয়, পাথুরে ইতিহাসও নয়। ‘বাঙালনামা’ আবিস্তৃত সমাজজীবনের কাহিনি। “রোমন্থন”-খ্যাত লেখকের কলমে ভিন্ন স্বাদের স্মৃতিকথা। হারিয়ে যাওয়া ধূসর জগতের কিংবা হারাতে থাকা সময়ের নিবিড় বিবরণ। এই স্মৃতিকথার শুরু ১৯২৬ সাল, অর্থাৎ লেখকের জন্মের বছর থেকে। তারপর বর্তমান কাল অবধি এর সময়সীমা। ফেলে আসা আশি বছরে অতি শৈশব-কৈশোরের পূর্ববঙ্গ, সেখানকার বিস্মৃতি মানুষজন এবং বিলুপ্ত জীবনযাত্রা, পঞ্চাশের দশকের অক্সফোর্ড আর এখনকার সেই পশ্চিমি নালন্দা, গতশতাব্দী জুড়ে মহাদেশ থেকে মহাদেশে লেখকের সফর ও সুদীর্ঘ প্ৰবাসজীবন ব্যাপ্ত হয়ে আছে। এই রচনায়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্ৰজ্ঞা আর রসমাধুৰ্যে ভরপুর এক পথিকজীবনের ইতিবৃত্ত “বাংলানামা”
“বাংলানামা” বইয়ের প্রথম সংস্করণের নিবেদন: ২০০৬ সালের গোড়ার দিকে ‘বাঙালনামা' লেখা শেষ করি। ২০০৭-এর ১৭ এপ্রিল “দেশ” পত্রিকায় লেখাটির শেষ কিস্তি প্রকাশিত হওয়ার কথা। ‘বাঙালনামা’র শেষ পরিচ্ছেদে লিখেছি,-আমি হৃৎপিণ্ডের একটি “ভালব’ বদল করার জন্য অন্ত্রোপচারে সম্মতি দিয়েছি। সেই অস্ত্ৰোপচার হবে ২০০৭ সালের ১৮ এপ্রিল- ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘বাঙালনামা’র শেষ কিস্তি ছাপা হওয়ার পরের দিন। এই যোগাযোগের পিছনে ভাগ্যদেবতার কোনও প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত আছে কি না জানি না। “দেশ’ পত্রিকার গ্রাহক শুনি লক্ষাধিক। তা হলে পাঠকসংখ্যা তার অন্তত দু-তিন গুণ। এই বিরাট সংখ্যার পাঠকমণ্ডলীর কাছ থেকে যে প্রতিক্রিয়া পেয়েছি তা সত্যিই অপ্রত্যাশিত এবং আমার কাছে কিছুটা দুর্বোধ্য। কারণ আমার জীবন সাদামাটা শিক্ষাজীবীর। দীর্ঘদিন প্রবাসী,- তবে সে অভিজ্ঞতাও কয়েক হাজার বাঙালি শিক্ষাজীবীর। তাই রোমাঞ্চইনি এই জীবনকথা পাঠক-পাঠিকার কেন ভাল লাগল। তার কোনও সদ্ব্যাখ্যা আমি পাইনি। পাঠকদের চিঠিতে আমার অনেক ভুল দেখানো হয়েছে। সম্পূর্ণ স্মৃতিভিত্তিক রচনা,- এবং অস্ত্ৰোপচারটি এক বছর আগে হওয়ার কথা ছিল, সেই কারণে একটু তাড়াতাড়িতে লেখা। ফলে বেশ কিছু ভুল আছে। সেগুলি শোধরাতে যাঁরা সাহায্য করেছেন, তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তবে বলি- অনেক ক্ষেত্রে ভুল পত্ৰলেখকরাই করেছেন, আমি না। আর কিছু পত্ৰলেখকের চিঠিতে এক বিচিত্র বিদ্বেষ-প্রণোদিত মনোভঙ্গির প্রকাশ দেখেছি। অনেকেরই আপত্তি— মুসলমানদের আমি যথোচিত গালিগালাজ করিনি। এবং এক পত্ৰলেখকের গালিগালাজের লক্ষ্য সুশোভন সরকার এবং সুখময় চক্রবর্তী। এ বিষয়ে তার বক্তব্য সম্পূর্ণ মিথ্যা। চিঠিটি ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত না হওয়ায় শুনেছি লেখক অন্যত্র ওটি ছাপাবার ব্যবস্থা করেন। ওঁর উদ্যোগ যথোচিত প্ৰশংসা করার ভাষা আমার নেই। আক্ষেপের কথা,-শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে এ জাতীয় ব্যক্তি অপ্রতুলনা, ঔপনিবেশিক যুগের বহুব্যাপী ব্যর্থতাবোধ আমাদের জাতীয় চরিত্রের অঙ্গ হয়ে গেছে। আমাদের ঈর্ষা-বিদ্বেষের ব্যাখ্যা সেইখানে খুঁজতে হয়। বহু মানুষের সাহায্য এবং উৎসাহ এই রচনা সম্ভব করেছে। তাদের মধ্যে অনেকে 'দেশ' পত্রিকা এবং ‘আনন্দ পাবলিশার্স-এর কমী। এই দুই সংস্থা তাদের কর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না-জায়েজ ঘোষণা করেছেন। অতএব, হৃদয়ের কথা হৃদয়েই রইল। যাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারলাম না,-- আশা করি তারা টেলিপ্যাথির সাহায্যে বুঝে নেবেন। কয়েকটি মানুষকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ব্যাপারে। আর একটু সোচ্চার হচ্ছি। তাদের শীর্ষে প্ৰয়াত বন্ধু কুমার মুখার্জি এবং অমর সান্যাল। কুমার “রোমন্থন” প্রকাশ হওয়া অবধি বর্তমান লেখাটি লিখতে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। দুই কিস্তি প্ৰকাশ হওয়ার পর তিনি চলে গেলেন। আমার নানা অনুল্লেখ্য কাজের সাক্ষী অমর সান্যাল মহা উৎসাহে লেখাটি পড়ছিলেন। যে কিস্তিতে ওঁর কথা লিখেছি, সেটি প্রকাশিত হওয়ার কয়েকদিন আগে তিনিও লোকান্তরিত হলেন। আমার সমস্ত লেখাটি ধাপে ধাপে যাদের মাথায় লোষ্ট্রবৎ নিক্ষেপ করেছি। তাদের মধ্যে প্রথম উল্লেখযোগ্য ঔপন্যাসিক-অধ্যাপক কুণাল বসু এবং তাঁর পত্নী সুস্মিতা। অক্সফোর্ডে ওঁদের বহু শ্ৰান্ত সন্ধ্যাস্মিত মুখে এই অত্যাচার সহ্য করে কেটেছে। আমার স্ত্রীও এই উৎপীড়নের সহ-শিকার ছিলেন। চতুর্থ এবং পঞ্চম যে দুই ব্যক্তি এইভাবে উৎপীড়িত হয়েছেন দুর্ভাগ্যক্রমে তারাও ‘আনন্দবাজার’ সংস্থার কর্মী, ফলে তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা তাদেরও টেলিপ্যাথি মারফত বুঝে নিতে হবে। এই বইটি উৎসৰ্গিত লীলালক্ষ্মী বিদ্মরাজা, তার জন্মদাত্রী আমার কন্যা সুকন্যা এবং তস্যা মাতা হাসিকে। আমার জীবনরস যখন শুকিয়ে আসছিল তখন লীলালক্ষ্মীর আবির্ভাব। এখন আরও একশো বছর বাঁচতে ইচ্ছে করছে। শুনে লীলা সন্দেহ প্ৰকাশ করলেন। বললেন "Dadu, you will be very old by that time." Vists একটু চিন্তা,- So Shall I
Tapan Roychowdhury জন্ম ১৯২৬ সালে, পূর্ববঙ্গের কুমিল্লা শহরে। পৈতৃক ভিটে বরিশালের কীর্তিপাশা। শিক্ষা বরিশাল জেলা স্কুল, স্কটিশ চার্চ কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং অক্সফোর্ডের বেলিয়াল কলেজে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট. ডিগ্রি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় ইতিহাস ও সভ্যতার প্রাক্তন অধ্যাপক এবং সেন্ট অ্যান্টনিজ কলেজের প্রাক্তন ফেলো। প্রথম জীবনে পড়িয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তীকালে জাতীয় অভিলেখাগারের সহকারী অধ্যক্ষ, দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সের অধ্যক্ষ ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের অধ্যাপক পদে বৃত ছিলেন। এ ছাড়া হার্ভার্ড, পেনসিলভেনিয়া, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকো, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে অধ্যাপনা করেছেন। তার লেখা গ্ৰন্থ ইউরোপ রিকনসিডার্ড’ ১৯৮৭ সালে রবীন্দ্র পুরস্কার পায়। “রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্ৰাপ্তর পরিচারিতচর্চা” তার লেখা প্রথম বাংলা বই। কলকাতা, বর্ধমান, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি. লিট ও ভারত সরকার প্রদত্ত পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত ড. রায়চৌধুরী ভারতীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের অন্যতম খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞ।