"জীবনের ধ্রুবতারা" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল ‘শান্তিময়', স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নতুন নাম রাখলেন, ‘শান্তিদেব’। আজ শান্তিদেব ঘােষ নামেই তাঁর যাবতীয় খ্যাতি-যশ, প্রতিষ্ঠা-পরিচিতি। কিন্তু নাম থেকে ‘ময়’ মুছলেও, জীবনে এসে মিশেছে অন্যভাবে। যাঁর হাতে এই বদল, তাঁকেই ঘিরে, তাঁরই চর্চায় আর অনুধ্যানে শান্তিদেব ঘােষের সারাটি জীবন হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রময় সেই ছ'মাস বয়স থেকেই তিনি শান্তিনিকেতনে, প্রথম দিনটিতেই সস্নেহে নিজ ক্রোড়ে তাঁকে স্থান দিয়েছিলেন। আশ্রমগুরু রবীন্দ্রনাথ। আর সেই পুণ্য মুহূর্ত থেকেই তাঁর জীবনের কেন্দ্রেও গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের চিরস্থায়ী এক আসন। রবীন্দ্রনাথ শান্তিদেব ঘােষের শিক্ষাগুরু, দীক্ষাগুরু ; তাঁর জীবনের এক ও অনন্য ধ্রুবতারা। নিজেকে জানতে-জানতে জীবনের পথে যতই এগিয়ে চলেছেন তিনি, সেই জানারই সঙ্গে-সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন রূপে চলেছে এই ধ্রুবতারাকেও নানা দিক থেকে নানা ভাবে নতুন করে চেনা। আজ ছিয়াশি বছরের প্রান্তে পৌঁছে সেই সমূহ অভিজ্ঞতা আর সেই অফুরান উপলব্ধিরই কথা শােনাতে চেয়েছেন শান্তিদেব ঘােষ তাঁর এই আত্মস্মৃতিমূলক অসামান্য গ্রন্থে। অসামান্য, কেননা, এ-গ্রন্থে যতটা শান্তিদেব ঘােষের নিজের জীবনের কথা, তার ঢের বেশি রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ। তাঁর পুণ্য সান্নিধ্যস্মৃতির বিবরণ, তাঁর পূর্ণ মূর্তির অন্বেষণ। স্মৃতি যেখানে শেষ, তার পর থেকেই বলা যায় এই অন্বেষণের সুচনা। সমকালিক নথি-বিবরণ আর নিজস্ব স্মৃতির খতিয়ান থেকে, শান্তিনিকেতনের আশ্রমজীবনে বড় হয়ে-ওঠার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে, রবীন্দ্রময় জীবনচর্যার অনুভব-উপলব্ধির নির্যাস থেকে শান্তিদেব ঘােষ এ-গ্রন্থে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন এতকাল-অদেখা রবীন্দ্রনাথের স্বরূপকে, যা কিনা অবিচ্ছেদ্যরূপে জড়িয়ে আছে তাঁর শিক্ষা ও আশ্রমভাবনার সঙ্গে, নৃত্য-গীত-অভিনয়ের চর্চার সঙ্গে, এসব নিয়ে এবং এসব ছাপিয়ে মনুষ্যত্বের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের এক লােকোত্তর জীবনদর্শনের সঙ্গে। আর এই কারণেই, গুরুদেবের সঙ্গে একাত্ম শান্তিদেব ঘােষের। এই আত্ম-স্মৃতিকথার পরিসমাপ্তিও সেই মুহূর্তে এসে—যখন তাঁর জীবনের ধ্রুবতারারও লৌকিক জীবনের অবসান। একইসঙ্গে, এ-গ্রন্থের চালচিত্রে ফুটে উঠেছে আজ থেকে প্রায় এক শাে বছর আগের পূর্ব বাংলার এক গ্রামের ছবি, গ্রামীণ জীবনযাত্রার ছবি, তাঁর পারিবারিক অ্যালবামের বিভিন্ন মানুষজনের ছবি, শান্তিনিকেতন আর শ্রীনিকেতনের তিল তিল করে গড়ে ওঠার ছবি, আশ্রমিক জীবনের শিক্ষাপদ্ধতি। ও বিভিন্ন শিক্ষাগুরুর ছবি, এমন-কি, আদর্শ আর আদর্শচ্যুতিরও ছবি। যেমন অন্তরঙ্গ, তেমনই বর্ণাঢ্য সেই সমুদয় ছবি। অকপট, তবু অনাবিল। রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে যেমন, আত্মস্মৃতির সূত্রে খণ্ড ইতিহাসের এক উজ্জ্বল দলিল রূপেও তেমনই অপরিহার্য গ্রন্থ হয়ে উঠেছে শান্তিদেব ঘােষের ‘জীবনের ধ্রুবতারা।
জন্ম : ২৪ বৈশাখ, ১৩১৭ বঙ্গাব্দ। পিতা—স্বদেশকর্মী ও শ্রীনিকেতনের রূপকার কালীমোহন ঘোষ, মাতা—মনোরমা দেবী। এক বছর বয়স থেকে শান্তিনিকেতনে। সেখানেই বিদ্যালয়শিক্ষা। শিশুবয়স থেকেই সংগীতে স্বাভাবিক-অনুরাগ ও শক্তিমত্তার পরিচয়, ফলে রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে সংগীতশিক্ষার সুচনা। হিন্দুস্থানি সংগীত শেখেন ভীমরাও শাস্ত্রীর কাছে। ১৯৩০ সালে বিশ্বভারতীর সংগীতশিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯৩৯ সালে সংগীতভবনের পরিচালক, ১৯৪৫-এ অধ্যক্ষ। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর ১৯৫৪-তে রবীন্দ্রসংগীত ও নৃত্যের প্রধান অধ্যাপকের দায়িত্ব পান। ১৯৬৪-৬৮ এবং ১৯৭১-৭৩, দু’বার বৃত হন সংগীতভবনের অধ্যক্ষপদে। ১৯৭৪-এ অবসর। এরপর দু’বছর অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক রূপে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের গবেষণার কাজ। ১৯২৬ সাল থেকে সংগীতের পাশাপাশি নৃত্যচর্চারও সূচনা। গুরুদেবের ইচ্ছানুসারে ১৯৩১-এ দক্ষিণ ভারতে কথাকলি নাচ শিখতে যান। ১৯৩৭-৩৯ সালে ক্যাণ্ডি ও জাভাবালীর নৃত্য শিখতে যান সিংহল, বর্মা ও ইন্দোনেশিয়ায়। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় তাঁর বিভিন্ন নাটকের অভিনয়ে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি, নৃত্যনাট্য প্রযোজনাতেও হয়ে ওঠেন গুরুদেবের প্রধান সহায়ক। বহু সম্মানভূষিত জীবন। ১৯৭৭-এ সংগীত নাটক আকাদেমির ফেলো। ১৯৮০ সালে সুরেশচন্দ্র-স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার। ভারত সরকার প্রদত্ত পদ্মভূষণ ১৯৮৪। ওই বছরই বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত দেশিকোত্তম। রচিত গ্রন্থাদির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য : রবীন্দ্রসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত বিচিত্রা, Music and Dance in Rabindranath Tagore's Educational Philosophy. সহধর্মিণী : শান্তিনিকেতন কারুসংঘের অন্যতম শিল্পী ইলা ঘোষ।