"বাংলার ধর্ম ও দর্শন" বইটির ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ দেহ-আশ্রয়ী জ্ঞান বিস্তৃত হয়েছে সৃষ্টি, প্রকৃতি ও প্রাণের রহস্যমােচনের দিকে। প্রজ্ঞা ও উপায়কে যুক্ত করে মুক্তি ও আনন্দকে পেতে সহজসত্তা অর্জন করতে চেয়েছেন বৌদ্ধ সহজিয়াগণ। নাথযােগীরা যােগবিভূতির কল্যাণে কীভাবে শুদ্ধ দেহ লাভ করে। অমরত্বের পথ পাওয়া যায় তার তত্ত্ব ও পদ্ধতি বের করতে সচেষ্ট হয়েছেন। মরমী সূফী সাধকগণ পরম ভাবের ভেতর নিজের সত্তার স্থায়িত্ব কীভাবে দেয়া যায়: তার তত্ত্ব ও পদ্ধতি নিয়ে ভেবেছেন। ভক্তি আশ্রয়ী বৈষ্ণবগণ পরমের প্রকাশকে খুঁজেছেন মানব সম্পর্কের ভেতর, আবার মানব অস্তিত্বকেও উপলদ্ধি করতে চেয়েছেন তূরীয় সত্তার ভেতর। বাউল সাধক পরম ভাবকে প্রতিষ্ঠা দিতে এবং সেই ভাবের বিকাশ দেখতে চেয়েছেন। তারা পরমকে মানব দেহের সীমায় এনে সাধনার কেন্দ্রীয় বিষয় করে তুলেছেন মানুষকেই। এইসব সাধক সম্প্রদায়ের অন্বেষণ আমাদের দেখিয়েছে বাঁচবার জন্য ভাবনা ও বিশ্বাসের নানা দিগন্ত। এ এমনই এক বিস্তার যা ইন্দ্রিয় ও অতীন্দ্রিয়ের দৃষ্টিকে প্রসারিত করে দেয়। এ থেকে আমাদের নির্মোহ ও বৈচারিক বিবেচনা নিজেদের জন্য সত্যপথ বেছে নিতে সাহায্য করে। ইউরােপীয় উপনিবেশ তাদের শাসক সত্তার বৈধতা দিতে আমাদেরকে বুঝিয়েছে, আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলাের নাকি কোনাে পরিণতি বা কোনাে ধারাক্রম নাই। এ বক্তব্য যে কতটা অসার ও মিথ্যা তা চোখের উপর থেকে উপনিবেশের চশমা খুলে ফেলে নিজেদের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে ভালাে করেই বুঝতে পারা যায়। উপনিবেশপূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির ভেতর দানা বেধে আছে জাতিসমূহের যে ধর্মবােধ ও ভাবুকতা তাকে কর্ষণ করে, তার সঙ্গে আত্মপরিচয়কে যুক্ত করেই কেবল নিজের বিশ্বাসের ভূমিতে দাড়িয়ে ঔপনিবেশিক ক্ষতিকে মােচন করা যেতে পারে। বাঙালির আত্ম-পরিচয় কেবল জাতি হিসাবে বাঙালির উদ্ভব কিংবা ভাষা হিসাবে বাংলার জন্ম বা বাংলা নামের একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের উদ্ভবের মধ্যে সীমিত নয়। ভূখণ্ড বা ভাষা হিসাবে বাংলা নামের সঙ্গে যুক্ত মানুষের সাংস্কৃতিক পরিচয় খুঁজতে হবে তার সংস্কৃতির নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ যে বিশ্বাস ও ভাবুকতাকে আশ্রয় করেছে তার ভেতর। ব্রিটিশ উপনিবেশপূর্ব বাংলার সহস্র বছরের সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিতে হিন্দু-মুসলমান কিংবা সূফী-বৈষ্ণব বাউলের ভাবুকতার প্রকাশ যেমন ঘটেছে তেমনি সাংস্কৃতিক সংশ্রয়ের এই ধারাসমূহের ভেতর স্পষ্টত পাওয়া যাবে প্রাচীন জাতি সমূহ যেমন অস্ট্রিক-মঙ্গোল-দ্রাবিড়ের মানস-বীজ, সাংখ্য-তন্ত্র-যােগ দর্শনে যার প্রকাশ আছে। উপনিবেশপূর্ব বাংলায় এদেশের মানুষের দার্শনিক ভাবনা প্রকাশিত হয়েছে তৎপরতার অনুষঙ্গ হয়ে। সেকারণে দার্শনিক গােষ্ঠীগুলাে এখানে পেয়েছে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পরিচয় ধর্মসাধকের পারমার্থিক মুক্তি মানুষের প্রত্যহের শ্রম-ঘাম-দুঃখ-বেদনার জগৎকে এড়িয়ে যায়নি কখনাে। বাঙ্গালির সংশ্লেষী মন নিজের বিশ্বাসকে দৃশ্যমান করেছে তার বাক্য, কর্ম, খাদ্যাভ্যাস এবং এমনকি পােশাক-পরিচ্ছদের ভেতর দিয়ে। সাধক ও ভাবুকগণ নিজের সত্তাকে খণ্ডিত করে দেখেননি বলেই আবেগানুভূতির উপরে চিন্তা বা যুক্তিশীলতা শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠতে পারেনি। তার সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিতে মানব সত্তা অখণ্ডরূপেই হাজির থেকেছে। চিন্তা সেখানে অনুভবের আশ্রয় নিয়ে রূপ পেয়েছে সংগীতের। ভাবুকতার প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে শিল্পের দাবির কথাও তারা ভুলে যাননি। বৌদ্ধ সহজিয়া কিংবা সূফী-বৈষ্ণব- বাউলের রচনা তাই আমাদের কাব্য-সাহিত্যের ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। কীসে মানুষের মুক্তি? বহু পুরানাে এই প্রশ্ন, যে প্রশ্নকে ঘিরে বাংলার সাধক ও ভাবুকগণ তাদের জীবনকে সত্যে প্রতিষ্ঠা দিতে খুঁজেছেন নানা উপায়। আর সত্য ধারণ করে বাঁচবার উপায় কী হবে তা বের করার প্রয়ােজনেই তারা বুঝতে চেয়েছেন জগতের স্বভাবকে। তারা জানতে চেয়েছেন জীবাত্মা ও জগতের সঙ্গে পারমার্থিক সত্তা কী রূপে সম্পর্কিত। এভাবে মুক্তির উপায়ের প্রশ্নে প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে বস্তুর অধিবিদ্যা। একজন তান্ত্রিক সাধকের জন্য আত্ম-অতিক্রমের পথ খুঁজে পেতে দরকারী হয়ে পড়েছে দেহের স্বভাবকে বােঝা।
রায়হান রাইন: জন্ম ৮ মার্চ ১৯৭১, সিরাজগঞ্জ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক। প্রকাশিত বই: গল্প আকাশের কৃপাপ্রার্থী তরু, পাতানো মায়ের পাহাড়, স্বপ্নের আমি ও অন্যরা, কয়েকটি সাদা কাঠগোলাপ; কবিতা-তুমি ও সবুজ ঘোড়া, একদিন সুবচনী হাঁস, নিক্রোপলিসের রাত; উপন্যাস-আগুন ও ছায়া, নিখোঁজ মানুষেরা; প্রবন্ধ-বাংলার দর্শন: প্রাক-উপনিবেশ পর্ব, এক মুঠো রূপক: শিল্প-সংস্কৃতি ও দর্শনে রূপকের ভাষা; সম্পাদনা-বাংলার ধর্ম ও দর্শন; অনুবাদ ও সম্পাদনা-মনসুর আল-হাল্লাজের কিতাব আল-তাওয়াসিন, আচার্য শান্তরক্ষিতের মধ্যমকালঙ্কার, ব্রোঞ্জের মৌমাছি ও অন্যান্য বিশ্বসাহিত্যের নির্বাচিত ছোটগল্প, অতীশ দীপঙ্কর রচনাবলি, কথাপুষ্প প্রজ্ঞাবানদের বলা গল্প। আগুন ও ছায়া উপন্যাস ও বাংলার দর্শন: প্রাক-উপনিবেশ পর্ব বইদুটির জন্য 'প্রথম আলো বর্ষসেরা বই' পুরস্কার পেয়েছেন ১৪২০ ও ১৪২৫ বঙ্গাব্দে।