ভূমিকা চিরন্তন ভারতসংস্কৃতি যুগে যুগে বিবর্তিত হয়ে অবশেষে পরিণত হয়েছে রবীন্দ্র- সংস্কৃতিতে, এমন কথা বললে বোধ করি অত্যুক্তি হয় না। কেননা, বিপুল রবীন্দ্রসাহিত্যে চিরন্তন ভারতের জীবন ও মননধারার চিরবিবর্তমান বিচিত্ররূপ যেভাবে ও যতখানি প্রতিফলিত হয়েছে, অন্য কারও সাহিত্যেই তা হয় নি। এমন-কি, সমগ্র বাংলা সাহিত্যেও ও তা হয়েছে বলা যায় না। রবীন্দ্রনাথ শুধু যে ভারতীয় সংস্কৃতির অতীত রূপকে নূতন বাণীতে উজ্জীবিত করেছেন তা নয়, বর্তমান ভারতকেও তিনি দেখিয়েছেন তার অভীষ্ট অগ্রগতি ও সার্থকতম পরিণতির পথ। এককালে রবীন্দ্রনাথ রামমোহনের পরিচয় দিয়েছিলেন ‘ভারতপথিক' বলে। আজ রবীন্দ্রনাথই আমাদের চোখে চিরতা ভারত- মহাপথের শ্রেষ্ঠ যাত্রীরূপে প্রতিভাত। রবীন্দ্রনাথ নিজেও ছিলেন ‘ভারত-আত্মার বাণীমূর্তি'। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে তাঁরই একটি উক্তি— “যথার্থ পুরাতন ভারত, যে ভারত চির-নূতন—যে-ভারতের বাণী, আত্মবৎ সর্বভূতেষু য পশ্যতি স পশ্যতি—তাকেই আমি চিরদিন ভক্তি করেছি।...আমার চিত্ত মহা- ভারতের অধিবাসী—এই মহা-ভারতের ভৌগোলিক সীমানা কোথাও নেই।” এই চিন্ময় মহা-ভারতের দুই রূপ—এক তার আধ্যাত্মিক রূপ, আর তার সাংস্কৃতিক রূপ। এই দুই রূপের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। বস্তুতঃ একই সত্তার দুই প্রকাশ মাত্র। ভারতপথিক রবীন্দ্রনাথের বহু পরিসর সাহিত্যে ভারতসত্তার এই দুই রূপই হয় প্রতিফলিত, না-হয় ব্যাখ্যাত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় ও সাহিত্যে প্রতিফলিত ভারতীয় প্রতিভার বিচিত্র সাংস্কৃতিক রূপের কিছু পরিচয় দেওয়াই এই গ্রন্থের প্রধান লক্ষ্য। এই গ্রন্থের ‘ভারতপথিক' অংশে আছে অতীত ভারতে সংস্কৃতিবিকাশের রবীন্দ্রভাষিত বিভিন্ন রূপের পরিচয়। আর ‘যুগনায়ক' অংশে আছে বহুযুগসঞ্চিত সমস্যায় সংশয়বিহ্বল বর্তমান ভারতকে রবীন্দ্রনাথের দেখানো বিপদ-উত্তরণের পথের বিবরণ। বলা বাহুল্য, আধুনিক ভারতের সমস্যার যেমন বিভিন্ন রূপ, তার থেকে নিষ্কৃতি লাভের উপায়ও তেমনি বিভিন্ন-প্রকার। এক উপায় প্রচলিত শিক্ষার সংস্কার ও প্রসার-সাধন। এ বিষয়ের সবিস্তার আলোচনা করেছি ‘রবীন্দ্রনথের শিক্ষাচিন্তা' গ্রন্থে। আর-এক উপায় সমবেত ইচ্ছাশক্তি-যোগে কর্মসাধনা। এ বিষয়ের আলোচনা আছে ‘ইচ্ছামন্ত্রের দীক্ষাগুরু রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থে। এই গ্রন্থের উক্ত ‘যুগনায়ক' অংশে আলোচিত হয়েছে প্রধানতঃ আমাদের ভারতীয় সমস্যা-সমাধানের কিছু নীতিনির্দেশের কথা। এ বিষয়ে আরও আলোচনা ও বিচার বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা আছে। সবশেষে ‘বিচিত্র’ অংশে আছে রবীন্দ্র-বিষয়ক কয়েকটি বিচ্ছিন্ন রচনার সংকলন।
জন্ম ২৭ এপ্রিল ১৮৯৭। পূর্ব বাংলার কুমিল্লা জিলায়। প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ। প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। কর্মজীবনে খুলনা দৌলতপুর কলেজে ইতিহাস ও বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক (১৯৩২-৪২)। পরে বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্র অধ্যাপক ও রবীন্দ্রভবনের অধ্যক্ষ (১৯৪২-৬৫)। বাংলা ছন্দ বিষয়ে প্রবাসী পত্রিকায় (১৯২২-২৩) ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখে সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এই সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যলাভ ও পরিণামে বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনার কর্মগ্রহণ। প্রায় সারাজীবনের (১৯২২-৮৬) গবেষণার ফলে তাঁর রচিত শতাধিক ছন্দ প্রবন্ধ এবং আধুনিক বাংলা ছন্দসাহিত্য’, ‘নূতন ছন্দ পরিক্রমা’ প্রভৃতি বহু গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যের একটা বড় অভাব পূরণ করেছে। ফলে ছন্দশাস্ত্রের নির্মাতা বলেই তার সর্বাধিক খ্যাতি। তা ছাড়া তিনি রবীন্দ্র সাহিত্য, ইতিহাস প্রভৃতি নানা বিষয়ে বহু প্রবন্ধ ও গ্রন্থের রচয়িতা। তাঁর ‘ভারতবর্ষের জাতীয় সংগীত’ বইটি রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমন’ গান সম্বন্ধে বহুব্যাপ্ত ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটিয়েছে। আর ভারতাত্মা কবি কালিদাস' বইটি পেয়েছে পশ্চিমবাংলার বঙ্কিম পুরস্কার । মৃত্যু : ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬