"চিত্তরঞ্জন অথবা যযাতির বৃত্তান্ত" বইয়ের পিছনের কভারের লেখা: নয়টি গল্প নয় রকমের। আবার নয়টি গল্পের মূলাধার একটি গ্রন্থ। সে ‘মহাভারত'। 'মহাভারত' মানবজীবনের আকরগ্রন্থ। পাঁচহাজার বছরের পুরনাে এই মহাকাব্যটি এখনাে কীভাবে বাঙালি জীবনে গভীরভাবে প্রােথিত হয়ে আছে, এই গল্পগ্রন্থে তারই অনুসন্ধান চালিয়েছেন হরিশংকর জলদাস। ‘সহােদর' গল্পে কুন্তীর হাহাকারের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে বর্তমানের কুমারী মা-দের আর্তনাদ। ‘তুমি কে হে বাপু’তে ব্যাসদেবের সঙ্গে অদ্বৈত। মল্লবর্মণের সাক্ষাৎ। এই গল্পে বিবর্ণ সম্প্রদায়ে জন্ম নেওয়া দুই মহাজনের বেদনা এক বিন্দুতে মিশেছে। সুরেন্দ্র গাওয়াল’ ও ‘ঢােলদাস’ গল্প। দুটোতে দুজন অন্যরকম মানুষের জীবনালেখ্য বর্ণিত। সুরেন্দ্র আর মনমােহনের মতাে মানুষ আছে বলেই অশেষ ক্লেশের মধ্যেও জীবন এখনাে অনেক আকর্ষণীয়। চিত্তরঞ্জন অথবা যযাতির বৃত্তান্ত' গল্পটিতে ‘মহাভারতের আশ্রয়ে আপনারই জীবনকথা যেন রূপায়িত। কুন্তীর বস্ত্রহরণে প্রাচীন ও বর্তমানকালের নারীলাঞ্ছনার বেদনা একাকার হয়ে অশ্রু বিসর্জন করছে। ব্যর্থ কামে’ ‘মহাভারতের পাণ্ডু বর্তমান কালের ধরণীবাবু হয়ে উপস্থিত। বিষয়, ভাষা ও গল্পশৈলীর বৈচিত্র্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে হরিশংকর জলদাস আপনার ভেতরটাকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছেন। আপনার ভাবনায় নতুন সংযােজন ‘চিত্তরঞ্জন অথবা যযাতির বৃত্তান্ত গল্পগ্রন্থটি।
প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হরিশংকর জলদাস ১৯৫৫ সালের ১২ই অক্টোবর বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের উত্তর পতেঙ্গা গ্রামের এক জেলে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা যুধিষ্ঠির জলদাস পেশায় ছিলেন একজন জেলে। ফলে আর্থিক অভাব অনটন আর অর্থনৈতিক টানাপোড়েনই ছিল হরিশংকরের বেড়ে ওঠার সঙ্গী। হরিশংকর জলদাসের শৈশব-কৈশোর কাটে পতেঙ্গার কৈবর্তপাড়ায়। তার বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে জেলের জীবনযুদ্ধে না জড়িয়ে শিক্ষিত করবেন যেন ছেলে সম্মানের জীবনযাপন করতে পারে। হরিশংকরের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় দেবেন্দ্রলাল দে’র আদাবস্যার নামের এক পাঠশালায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে তিনি ভর্তি হন পতেঙ্গা বোর্ড প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৭১ সালে পতেঙ্গা হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে বাবার স্বপ্ন পূরণে আরো একধাপ এগিয়ে যান হরিশংকর। 'জাইল্যা' ঘরের সন্তান বলে তাকে বিভিন্ন সময়ে অপমানিত হতে হয়েছে, শুনতে হয়েছে ‘জাওলার ছাওয়াল’ কটুক্তি। সেই কথার উচিত জবাব দিতে তিনি ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ‘নদীভিত্তিক বাংলা উপন্যাস ও কৈবর্ত জনজীবন’ বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এখানে তিনি জেলেদের জীবনের সকল আনন্দ-বেদনা, উৎপত্তি-বিকাশ, তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন ইত্যাদি তুলে ধরেন। পেশাগত জীবনে হরিশংকর জলদাস চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান। কিন্তু কর্মজীবনের শুরুতে অভাবের দিনগুলোতে তিনি দিনে শিক্ষকতা এবং রাতে বাবার সাথে সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতেন। ৪৭ বছর বয়সে তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘জলপুত্র’ লেখেন। এরপর, ক্রমাগত বাজারে আসতে থাকে হরিশংকর জলদাসের নতুন বই। হরিশংকর জলদাসের বইগুলোতে সবসময়ই উঠে এসেছে নিপীড়িত, প্রান্তিক এবং নিচুতলার মানুষের কথা। হরিশংকর জলদাসের উপন্যাসসমগ্র সমৃদ্ধ হয়েছে ‘আমি মৃণালিনী নই’, ‘হৃদয়নদী, ‘রামগোলাম’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ইত্যাদি চমৎকার উপন্যাসের মাধ্যমে। হরিশংকর জলদাসের ছোটগল্প ‘লুচ্চা’, ‘জলদাসীর গল্প’, ‘মাকাল লতা’ প্রভৃতিও পাঠকপ্রিয়। এছাড়া দুটি আত্মজীবনী রচনা করেছেন তিনি। ‘কসবি’, ‘দহনকাল’, ‘জলপুত্র’ হরিশংকর জলদাস এর সেরা বই। মধ্যবয়সে লেখা শুরু করলেও সাহিত্যকর্মে নতুন মাত্রা যোগ করায় তিনি বহু পুরস্কার অর্জন করেছেন। ২০১১ সালে ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা পুরস্কার’ (দহনকাল), ২০১৩ সালে ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’ (জলপুত্র), ‘ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার’ (প্রতিদ্বন্দ্বী), ‘বাংলা অ্যাকাডেমি পুরষ্কার’, ‘সিটি আনন্দ আলো পুরস্কার’ সহ ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৯ সালে তিনি পেয়েছেন ‘একুশে পদক’।