যুগে যুগে কালে কালে রমণীমন নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। রমণীমন বা মেয়েমানুষের মন হলো অভেদ্য রহস্যের অন্তরালে লুকানো এমনি এক মহার্ঘ ধন যা খুব কম মানুষই উদ্ধার করতে পেরেছে। বলা হয়, নারীর মন হাজার বছরের সাধনার ধন। কেউ তো আর হাজার বছর বাঁচে না। তাই হয়তো ওই মনের সন্ধানও কেউ পায় না। বাৎসায়নের মতে, কামের আছে চৌষট্টি কলা- যা মানুষ আয়ত্ব করতে পেরেছে, এবং কার্যক্ষেত্রে তার প্রয়োগও এখন বিশ্বব্যাপী। কিন্তু প্রবাদে প্রচলিত নারীর আয়ত্বে মাত্র ষোলটি কলা- যার একটির প্রয়োগ করলেই নাকি পুরুষ দিশেহারা। সাধারণত এই রমণীমনের এই কটি কলা ব্যবহৃত হয়েছে সর্বাধিক যে যে ক্ষেত্রে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাজা বা শাসকমনের ওপর। যুগে যুগে কালে কালে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রেও এর কম প্রয়োগ হয়নি। আবার অন্য অনেক ক্ষেত্রেও যে হয়নি, তা নয়। কালজয়ী সব প্রেমলীলার মিলনে-বিচ্ছেদে এই রমণীমন ঠাঁই করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। আবার এই মন এমনভাবে জয় করেছে কোনো কোনো পুরুষ, যে, অগণিত রমণী তাদের প্রেমিকের সঙ্গে সহমরণেও গিয়েছে। সবচেয়ে বড় আশ্চর্য যে, ভূরি ভূরি সহায় সম্পদ কিংবা অস্ত্র-গোলাবারুদের ব্যবহার করে যেখানে কোনো ফল পাওয়া যায় না, একটি কোমল নিটোল রমণীমন তাকে অনায়াসে জয় করতে পারে। তাই যুগে যুগে রমণীমন নিয়ে জ্ঞানী গুণী দার্শনিকের গবেষণার কোনো শেষ নেই। কেউ কূল পায় তো কেউ অথৈ সমুদ্রেই হাবুডুবু খায়। এত এত ক্ষমতা থাকার পরেও দেখা যায় আজ অবধি নারীকেই নির্যাতিত হতে হয়েছে বেশি, খেসারত দিতে হয়েছে বেশি। আবার পরাজয়ের ডালা বরণ করে ডুব দিতে হয়েছে অন্ধকার সমুদ্রে। এমন একটি প্রমাণ ‘রমণীমন’ থেকেই উপস্থাপন করি। আলোচ্য এই গ্রন্থটির রচয়িতা সদ্য প্রয়াত কবি সাযযাদ কাদির। তিনি রমণীমন নিয়ে বিস্তর কাজ করেছেন। বর্তমান গ্রন্থে তিনি ‘ইভা ও অন্যান্য’ অধ্যায়ে কুখ্যাত জার্মান একনায়ক হিটলারের যৌনজীবন নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেন। সেখানে হিটলারের দীর্ঘদিনের রক্ষিতা ইভা ব্রাউনের বর্ণনায় অনেক তথ্য জানা যায়। হিটলারকে কেউ কেউ সমকামী এবং অক্ষম পুরুষ ভাবলেও ইভা সেসব কথাকে কোনো পাত্তা না দিয়ে তাকে একজন সক্ষম পুরুষ হিসেবে বর্ণনা দেন। হিটলার কতটা যৌনপাগল পুরুষ এসম্পর্কে ইভা হিটলারের কমান্ডো বাহিনীর এক সদস্যকে যে বর্ণনা দেন তা থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করা যেতে পারে। হিটলারের কমান্ডো বাহিনীর প্রধান অটো স্করৎসেনি বলেছেন, “একদিন কথায় কথাই ইভা আমাকে বলেছেন: জানেন, মিলনের সময় ও বুটজোড়া পর্যন্ত খোলে না; মাঝেমধ্যে বিছানায় পর্যন্ত যায় না। মেঝেতে জায়গা করে নিতে হয় আমাদের। মেঝেতে অবশ্য খুব কামুক হয়ে পড়ে ও।” সুতরাং হিটলারের যৌনক্ষমতা সম্পর্কে নিঃসন্দিহান হওয়ার এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে। পরে অবশ্য হিটলারের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ইভা একই সাথে আত্মহত্যা করেন। সবচেয়ে আশ্চর্য যে যারাই হিটলারের রক্ষিতা ছিলেন, তাদের প্রায় সবাই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। জানা যায় মনপ্রাণ দিয়ে হিটলার একজনকেই সবচেয়ে বেশি ভালবেসেছিলেন তিনি হলেন আনগেলিকা (গেলি) রাউবাল (১৯০৮-৩১)। তিনি ছিলেন তার বৈমাত্রেয় বোনের কন্যা অর্থাৎ হিটলারের ভাগ্নি। গেলিকে সে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করতো। পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেও পালিয়ে যেতে পারেননি গেলি। একারণে গেলি প্রতিশোধ নিতে হিটলারের দীর্ঘকালের সঙ্গী ও শোফার এমিল মরিস এবং উৎসাহী নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক গড়ে তোলা ছাড়াও গোপনে মেলামেশার সুযোগে হাতের কাছে পাওয়া প্রায় সকল যুবকের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। শেষতক ১৯৩১ সালে গেলিও বুকে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। লেখকের মতে, “হিটলারের আরও অনেক শয্যাসঙ্গিনী বরণ করেছেন এমন শোচনীয় পরিণতি। ১৯৩৯ সালে মুয়েনচেন-এ মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্ট করেন ইংরেজ মহিলা ইউনিটি মিটফোর্ড (১৯১৪-৪৮)। মগজে বুলেট নিয়ে ধুঁকে ধঁকে মরেছেন তিনি পরবর্তী ন’বছর ধরে। হিটলারের এক পুত্র সন্তানের মা তিনি- এমন গুজব রয়েছে। সুজি লিপটাউয়ার নামে একজন সারারাত হিটলারের সঙ্গে যৌনাচার সেরে বাড়িতে ফিরে আত্মহত্যা করেন গলায় ফাঁস দিয়ে। আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন মারিয়া মিমি রিটার (১৯১১-৯২), তবে শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়ে যান তিনি। কী কারণ এতসব আত্মহত্যা ও অপমৃত্যুর? হিটলারের বিচিত্র যৌনাচার? হয়তো। তবে কেউ কি বলতে পারেন নিশ্চিত করে।” লেখক নারী ঘটিত আরো অনেক অনেক তথ্য উদ্ঘাটন করেছেন ইতিহাস, লোকরচনা ও সাহিত্য ভিত্তিক তথ্যাশ্রয়ী প্রবন্ধ-গবেষণা সিরিজের তৃতীয় গ্রন্থ এই ‘রমণীমন’-এ। এর আগে প্রকাশিত হয়েছে এ জাতীয় তার আরো দুটি গ্রন্থ- ‘রাজরূপসী’ ও ‘নারীঘটিত’। একই গ্রন্থের অপর অধ্যায় ‘সাহিবানের সর্বনাশ’-এ দেখান সম্রাট আকবরের আমলের এক লোমহর্ষক প্রেমকাহিনী। বীরপুরুষ মিরজা ও সাহিবানের প্রেম যখন তুঙ্গে তখন সাহিবানের অন্য কোথায় বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। এই খবর পেয়ে মিরজা সাহিবানকে রক্ষা করতে চেষ্টা করে এবং সাহিবানের বিয়ের আসরে সাহিবানকে বেরিয়ে আসার জন্য খবর পাঠায়। সাহিবান মিরজার খবর পেয়ে বেরিয়ে এসে দুজন পালাতে থাকে। এরই মধ্যে সাহিবানের ভাইয়েরা সঙ্গীসাথী নিয়ে ওদেরকে খুঁজতে বের হয়। এসময় ক্লান্ত হয়ে মিরজা একটি জায়গায় ঘুমিয়ে পড়ে। তখন সাহিবান ভাবে, যদি ওর ভাইয়েরা আক্রমণ করে তবে মিরজা তীর মেরে ওর ভাইদের হত্যা করে ফেলতে পারে। তাই সে মিরজার ঘুমের সময় গোপনে তূনীর সরিয়ে রাখে। এদিকে সাহিবানের ভাইয়ের তীর এসে বিঁধে মিরজার গলায়। তখন মিরজা বলে, সাহিবান তুমি খুব খারাপ কাজ করেছো। এসময় আহত রক্তাক্ত মিরজাকে বাঁচাতে সাহিবান ওকে জড়িয়ে ধরে। তখন একঝাঁক তীর এসে সাহিবানের সারা দেহ বিদ্ধ করে দেয়। এভাবে দুজনেরই জীবনাবসান ঘটে। সাযযাদ কাদিরের এ গ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায়ের প্রতিটি বর্ণনা এমন তথ্যবহুল ও রোমহর্ষক। পাঠক অধ্যায়গুলো পাঠে আনন্দ লাভ করবেন এতে সন্দেহ নাই। অন্যান্য অধ্যায়ের মধ্যে আছে- ভয়ঙ্করী আতলিয়া, পরনারী জুলেখা, আলেকজান্ডার তার জননী জায়া ভগিনী, শিরিন সুন্দরী, শোকাকুল শেরবানো, সিন্ধুর সাত সুন্দরী (লিলান চনেসর, সোরথ বাই দিয়াচ, নরি জাম তামাচি, মুঘল রানো, সুসুই পুনহুন, সুহিনি মেহর, উমের মারুই), লালসী এলিজা, বাংলার রাজরানী, জেনি চারচিল’স লাভারস, আইনস্টাইনের বোঝাপড়া, কলঙ্কী ক্লারা, চ্যাপলিন চমৎকার, এক যে ছিল গ্রিক, অজানা ডায়ানা, জাদুকরী জ্যাকি এবং শেষ অধ্যায়- কথা ও কামিনী : স্রষ্টা পুরুষ নষ্টা নারী। গ্রন্থটি পাঠে একদিনে যেমন সত্য ঘটনার আলোকে ইতিহাসের গভীরের অনেক অজানা অধ্যায় সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যাবে, অন্যদিকে পৃথিবীর অপার রহস্যঘন রমণীমন সম্পর্কে কিছু বিস্ময় জাগানিয়া তথ্যও জানা যাবে। ধারণা হয়, লেখক গ্রন্থটি রচনা করতে প্রচুর পড়াশোনা করেছেন ও বিষয়টির প্রতি অন্ধভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। তার বর্ণনা আকর্ষণীয় ও সহজ সাবলীল। তবে কিছু কিছু অধ্যায়ে ঘটনাগুলোকে এতটাই সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা করেছেন যে, পাঠককে বুঝতে একটু বেগ পেতে হতে পারে। এ অধ্যায়গুলো আর একটু বিস্তৃত বর্ণনার দাবি রাখে। এছাড়া নির্ভুল ও সুন্দর ছাপা-বাঁধাইয়ের একটি সুখপাঠ্য গ্রন্থ ‘রমণীমন’।
Sazzad Qadir- জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৪ই এপ্রিল, টাঙ্গাইলের মিরের বেতকা গ্রামের মাতুলালয়ে। তাঁর পিত্রালয় ওই একই জেলার দেলদুয়ারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স ও এমএ পাস করেছেন যথাক্রমে ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালে। শিক্ষাজীবন শেষে অধ্যাপনা করেছেন করটিয়া’র সা’দত কলেজে, পরে সহকারী সম্পাদক ছিলেন সাপ্তাহিক বিচিত্রা ও দৈনিক সংবাদ-এর। বার্তা সম্পাদক ছিলেন দৈনিক দিনকালের। ১৯৭৮-৮০ সালে ছিলেন গণচীনের রেডিও পিকিং-এর ভাষা-বিশেষজ্ঞ। ১৯৯৫-২০০৪ সালে ছিলেন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের পরিচালক। বর্তমানে দৈনিক মানবজমিন-এর যুগ্ম সম্পাদক। সাযযাদ কাদির নেশায় কবি, পেশায় সাংবাদিক। কবিতা ছাড়াও লিখেছেন ছোটগল্প, নাটক। পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন ইতিহাস থেকে কল্পবিজ্ঞান পর্যন্ত অনেক বিচিত্র ও কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়ে। বিদেশের জনপ্রিয় উপন্যাস থেকে রসমধুর লোককাহিনী পর্যন্ত অনেক স্মরণীয় সাহিত্যসম্ভার তিনি উপহার দিয়েছেন পাঠক-পাঠিকাদের। তাঁর উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : আজব তবে গুজব নয়, ইউএফও: গ্রহান্তরের আগন্তুক, উপকথন, উপকথন আবারও, উপকথন আরও, উপকথন ফের, গল্পগাছা, তেপান্তর, বরিবল নামা, মনপবন, সবার সেরা, সাগরপার এবং রঙবাহার।