চাটগামী রহিমাহুল্লাহর রচনাবলির মাঝে 'মানবদেহের শরয়ি বিধান' অনন্য একটি সংযোজন। এই বিষয়ে বিশ্লেষণধর্মী ফিকহি রচনা কতটা গুরুত্বের দাবিদার— তা আপনি সংশ্লিষ্ট অঙ্গন থেকে দৃষ্টিনিক্ষেপ না করলে বুঝতে পারবেন না৷ এককথায়— চাটগামী রহিমাহুল্লাহ এমন কিছু শুন্যতা পূরণ করে গেছেন, যা তাঁর হাতে না হলে আজও হতো কি না জানিনা৷ . মুফতি আজম রহ. তখন করাচিতে৷ মানবকল্যাণ ও সেবার শ্লোগানধারী 'আই ব্যাংক'-এর মুখপাত্র— উজালা নামের একটি পত্রিকা প্রগতিশীল আধুনিক মননের কতিপয় আলেম ও ডাক্তারের প্রবন্ধ প্রকাশ করতে থাকে ধারাবাহিকভাবে। যাতে তারা শরিয়তের আলোকে মানব-অঙ্গের সংযোজন, পোস্টমর্টেমের বৈধতা ও অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অনুমতি প্রমাণ করতে থাকে। এতে পাক ভারত উপমহাদেশের আলেম ও দীনদার শ্রেণির টনক নড়ে ওঠে৷ সবারই দাবি— এর সমাধান হওয়া চাই৷ এই দাবির পক্ষে দাঁড়িয়ে ইকরা ডাইজেস্ট নামের একটি সংঘ এ বিষয়ে প্রশ্নতালিকা করে বিভিন্ন দীনী প্রতিষ্ঠানে পাঠায়। এরপর পাকিস্তানের উলামায়ে কেরাম এর গুরুত্ব বিবেচনা করে বানুরিটাউনে 'মজলিসে হাজেরার' পক্ষ থেকে একটি সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারে অংশগ্রহণ করে— মুফতি রশিদ আহমাদ লুধিয়ানবি রহিমাহুল্লাহ, মুফতি ওলি হাসান টুংকি রহিমাহুল্লাহ, মাওলানা সলিমুল্লাহ খান, মুফতি রফি উসমানি রহিমাহুল্লাহ, মুফতি তকি উসমানিসহ অনেকে। ছিলেন এ গ্রন্থের লেখকও। সেমিনারে নানা পর্যালোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়, এ নিয়ে নতুনভাবে শরয়ি সমাধান রচনা আবশ্যক৷ রচনা তৈরির জন্য দুজন মুফতিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, যাদের একজন ছিলেন আল্লামা চাটগামী রহিমাহুল্লাহ। . তিনি লিখলেন। বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে তা প্রকাশ হলো। ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হলেন৷ এরপর মুফতি ওলি হাসান টুংকির পরামর্শে গ্রন্থাকারে মলাটবদ্ধ হলো আলোচিত সেই রচনা৷ উর্দু ভাষায় রচিত 'ইনসানি আ'যা কি পায়বন্দকারি আওর উসকে শরয়ি আহকাম' বইটি এতটা পাঠকপ্রিয় হলো যে— অল্প সময়েই বেশ কয়েকটি মুদ্রণ ফুরিয়ে এলো। এরপর মুফতি আজম রহিমাহুল্লাহ বাংলাদেশে চলে আসেন৷ এদেশে আসার পর বইটি অনুবাদের ব্যাপক আবদার আসতে থাকায় তিনি নিজের তত্ত্বাবধানে মুহাম্মদ আলি হুসাইন হাফিজাহুল্লার মাধ্যমে এর অনুবাদ করান৷ 'মানবাঙ্গ সংযোজন' নামে বইটি প্রকাশ হয়। বইটি বেশ প্রশংসা কুড়ায়। নতুন সংস্করণে ভাষা-নীরিক্ষণের পর আবারও আলোচিত সেই বইটি ইত্তিহাদ প্রকাশ করে। . এই বইয়ে তিনি মানুষের দেহ ও অঙ্গের মালিকানা, হতাহতের কারণ নির্ণয়ে পোস্টমর্টেমের বিকল্প পদ্ধতি, কৃত্রিম অঙ্গ ব্যবহারের হুকুম, চিকিৎসায় হারাম ও নাপাক দ্রব্য ব্যবহারের হুকুম, দেহদান ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয়ের হুকুম, প্রয়োজন বা জরুরতের রকমফের—সহ চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট বহু বিষয়ে ফিকহি দৃষ্টিকোণ থেকে বিস্তর লিখেছেন৷ যা শুধু বাংলাদেশ নয়, পাক ভারতের বহু আলেম ও ফিকহের ছাত্রদের কাছে দীর্ঘদিন ধরে সমাদৃত।
মুফতি আবদুস সালাম চাটগামী ১৯৪৩ সালে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার নলদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালে গ্রামে প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে বাবুনগর মাদরাসায় ভর্তি হন। তারপর ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রামের জিরি মাদরাসায় থেকে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করেন। ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশের প্রথম মুহাদ্দিস আল্লামা আবদুল ওয়াদুদ (রহ.)-এর নির্দেশনাক্রমে তিনি পাকিস্তানের জামিয়াতুল উলুম আল-ইসলামিয়া আল্লামা মুহাম্মদ ইউসুফ বানুরী টাউন করাচিতে ভর্তি হন এবং তৎকালীন মুহাদ্দিস আল্লামা মুহাম্মদ ইউসুফ বানুরী (রহ.)-এর তত্ত্বাবধানে প্রথম বছর তিনি উ”চতর হাদীসশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং পরের বছর ইফতা বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি আল-ফিকহুল ইসলামী নিয়ে পড়াশোনা করেন। হাদীস ও ইফতা বিভাগের শিক্ষা সমাপ্তির পর জামিয়াতুল উলুম আল-ইসলামিয়া আল্লামা মুহাম্মদ ইউসুফ বানুরী টাউনে মুফতি হিসেবে নিয়োগ পান। পরে তিনি এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান মুফতির পদ লাভ করেন এবং দীর্ঘ তিন দশক দায়িত্ব পালন করেন। এ প্রতিষ্ঠানের ইফতা বিভাগে প্রতি বছর ৯ হাজারের বেশি ফতওয়া জমা হত। সেই হিসেবে এ দীর্ঘ সময় তিনি তিন লাখের বেশি লিখিত ফতওয়া সম্পাদনা করেন, যা ওই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে অনন্য নজির স্থাপন করে। এছাড়াও করাচির ঐতিহ্যবাহী আহমদ উসমানী জামে মসজিদের খতীব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালে মুফতি আবদুস সালাম চাটগামী ইসলামি শিক্ষা প্রসারে নিজ দেশে ফিরে আসেন। করাচির বানুরী টাউন থেকে চলে এলেও প্রতিষ্ঠানে অন্য কাউকে প্রধান মুফতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বরং দেশে ফিরেও বিশেষ সম্মাননা হিসেবে মুফতি আবদুস সালাম চাটগামী করাচির উক্ত মাদরাসায় প্রধান মুফতি পদে ছিলেন। এরপর দারুল উলুম হাটহাজারীর পরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.)-এর আহ্বানে ২০০১ সালে দারুল উলুম হাটহাজারীয় প্রধান মুফতি হিসেবে যোগদান করেন। আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.)-এর মৃত্যুর পর পরিচালনা পরিষদের প্রধান হন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাবলির মধ্যে রয়েছে, জাওয়াহিরুল ফাতওয়া, আপ কা সুওয়াল আওর উন কা জওয়াব: আহাদীস কী রৌশনী মেঁ (উর্দু), ইসলামী মায়িশাত কে বুনয়াদী উসূল (উর্দু), মুরাওয়াজা ইসলামী ব্যাংকারী (উর্দু), ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মানব-অঙ্গের ক্রয়-বিক্রয় (বাংলায় অনূদিত), দিলজাগানো সুরভী মলফুযাতে বোয়ালভী (রহ.) ও করোনাকালীন সমস্যা ও তার শরয়ী বিধান ইত্যাদি। ২৯ মুহাররম ১৪৪৩ মোতাবেক ৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ (বুধবার) সকাল সাড়ে ১১ টায় দারুল উলুম হাটহাজারীর পরিচালনা কমিটির পরামর্শ সভায় তাঁকে পরিচালক ঘোষণার অল্পসময়ের মধ্যে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন।