"পাখি আমার একলা পাখি" বইয়ের ভূমিকার অংশ থেকে নেয়া: অসামান্য রূপবতী একটি মেয়ে রূপা। চোখ তার নীল। এই রূপসী কন্যের মা লেবানিজ, বাবা বাংলাদেশের। মা ছিলেন চারুকলার ছাত্রী, পরে নাইট ক্লাবের নর্তকী। মাত্র আধ ঘন্টার নােটিশে রূপা বিয়ে করে ফেললাে স্বল্প পরিচিত বেকার যুবক রঞ্জুকে। গুণ্ডা টাইপের একটি। ছেলে রূপাকে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছিল। অগত্যা পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে এই ব্যবস্থা। সম্ভাব্য পাত্র ছিল তিন জন। রঞ্জুর নাম ছিল দুই নম্বরে। হুট করে বিয়ে-পাত্রের পরিবার পছন্দ করেনি। তারপর কী ঘটলাে? অনেক নাটকীয়তা, মুহর্মুহু ঘটনার মােচড়, দ্বন্দ্ব, সংশয়, অবিশ্বাস, গাঢ় ভালােবাসার আবছা আভাস, দোলাচল ইত্যাদি নানামাত্রিক আবর্তে ঘুরপাক খেতে খেতে কাহিনি এগিয়ে চলে অনিবার্য পরিণতির দিকে। স্বাধীনচেতা, স্পষ্টভাষী রূপার ভাগ্যে কী ঘটলাে শেষ। অব্দি? রঙুই বা কী করে তারপর? জননন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ তার স্বভাবসুলভ কুশলী নৈপুণ্যে পরম যত্নে সৃষ্টি করেছেন এই উপন্যাস পাখি আমার একলা পাখি। কখনাে নির্মল রসিকতায়। উচ্ছল, কখনাে মানবিকতায় ভাস্বর, মানবমনের। সূক্ষ্ম-জটিল অনুভূতির বিশ্বস্ত চিত্রায়ন আমরা দেখতে পাই। এই কথাশিল্পী মানুষের মনােগহিনে আলাে-আঁধারির গােলকধাধার পথ নির্ভুল চেনেন। ঈর্ষণীয় এই ক্ষমতা তার সহজাত। বড়ই বিচিত্র মানুষের মন। সে জগতের ছবি নিখুঁতভাবে অঙ্কনে। এমন সফল শিল্পী দ্বিতীয় আর কে আছেন? পাঠককে চুম্বকের মত আটকে রাখে বহুল পঠিত এই উপন্যাস, পাঠান্তে বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে আসে নিঃসঙ্গ। একটি দীর্ঘশ্বাস! আচ্ছন্ন হয়ে থাকে হৃদয়।
বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তী হুমায়ূন আহমেদ। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম স্থান দখল করে আছেন। একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও নাট্যকার এ মানুষটিকে বলা হয় বাংলা সায়েন্স ফিকশনের পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি বেশ সমাদৃত। বাদ যায়নি গীতিকার কিংবা চিত্রশিল্পীর পরিচয়ও। সৃজনশীলতার প্রতিটি শাখায় তাঁর সমান বিচরণ ছিল। অর্জন করেছেন সর্বোচ্চ সফলতা এবং তুমুল জনপ্রিয়তা। স্বাধীনতা পরবর্তী বাঙালি জাতিকে হুমায়ুন আহমেদ উপহার দিয়েছেন তাঁর অসামান্য বই, নাটক এবং চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের বদৌলতে মানুষকে করেছেন হলমুখী, তৈরি করে গেছেন বিশাল পাঠকশ্রেণীও। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’ দেখতে দর্শকের ঢল নামে। এছাড়া শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, ঘেটুপুত্র কমলা প্রভৃতি চলচ্চিত্র সুধীজনের প্রশংসা পেয়েছে। অনন্য কীর্তি হিসেবে আছে তাঁর নাটকগুলো। এইসব দিনরাত্র, বহুব্রীহি, আজ রবিবার, কোথাও কেউ নেই, অয়োময়ো আজও নিন্দিত দর্শকমনে। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের জনক তিনি। রচনা করেছেন নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, জোছনা ও জননীর গল্পের মতো সব মাস্টারপিস। শিশুতোষ গ্রন্থ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রচনা, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমূহ এর পাঠক সারাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে। হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমগ্র পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিতও হয়েছে। সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), একুশে পদক (১৯৯৪), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূধন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮), শিশু একাডেমি পুরস্কার, জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদকসহ নানা সম্মাননা। হুমায়ূন আহমেদ এর বই, চলচ্চিত্র এবং অন্যান্য রচনা দেশের বাইরেও মূল্যায়িত হয়েছে৷ ১৯৪৮ সালের ১৩ই নভেম্বর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলায় কুতুবপুরে পীরবংশে জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের বেলভ্যু হাসপাতালে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। গাজীপুরে তাঁর প্রিয় নুহাশ-পল্লীতে তাঁকে সমাহিত করা হয়।