বাংলাদেশে গণিত আন্দোলনের এক যুগ অতিক্রান্ত। এই অনন্যসাধারণ সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনটি পরিচালিত হচ্ছে গণিত অলিম্পিয়াডকে ঘিরে, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে। ‘ঘরােয়া’ গণিত অলিম্পিয়াডের পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের অনুপ্রেরণা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যদিও দ্বাদশ শ্রেণিকে মানদণ্ড হিসেবে ধরে গণিত অলিম্পিয়াডের নকশা করা হয়, তবু দেশের মাটিতে গণিত অলিম্পিয়াডের মাপকাঠি আরাে ‘ছােট ক্লাস’ থেকে শুরু। তৃতীয় শ্রেণি থেকে। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির এই দুরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণ হলাে, ইমারত পােক্ত করতে হলে ভিত্তি আগে মজবুত হওয়া চাই। জ্ঞানরাজ্যের জমিনে মজবুত ভিত্তি গড়তে চাই ভালাে বই। পাঠ্যবই তাে বটেই, তবে পাঠ্যবইয়ের বাইরেও চাই অনেক অনেক বই। বাংলাদেশে গণিত আন্দোলনের ফলশ্রতিতে এখন বাজারে বাংলা ভাষায় লেখা দেশীয় গণিত বই পাওয়া যায় বহু। সব বই-ই যে মানসম্মত তা নয়, তবে গণিত প্রকাশনার মােট সংখ্যা আসলেই অবাক করার মতাে। কিন্তু এতাে এতাে বইয়ের ভিড়ে গণিতের একেবারে মৌলিক বিষয়গুলাে নিয়ে লেখা শিশুদের উপযােগী বই অত্যন্ত বিরল। তাহলে ভিত পাকা করার সেই সমস্যা তাে রয়েই গেল! প্রাথমিক ক্যাটাগরি, অর্থাৎ তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির উপযােগী, পাঠ্যবইয়ের সম্পূরক ভালাে মানের গণিত বইয়ের অভাব পূরণ করতে এই বইটি ভূমিকা রাখবে। এই বইটি পাঠ্যপুস্তকের বিকল্প নয়, বরং সম্পূরক। তবে কেউ যেন মনে না করেন যে এটি তথাকথিত কোনাে গাইড বই। এই বইটি হলাে খােলা আলাে-হাওয়ায় বেড়ে ওঠার রসদ। এরকম আরও রসদ শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়ােজন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “মন যখন বাড়িতে থাকে তখন তাহার চারি দিকে একটা বৃহৎ অবকাশ থাকা চাই।” সেই অবকাশের উপযােগ হিসেবে সংখ্যা ও অপারেটরের প্রাথমিক ধারণা থেকে শুরু করে ইউক্লিডীয় জ্যামিতির মৌলিক বিষয়গুলাে এই বইতে আলােচনা করা হয়েছে। রয়েছে পর্যাপ্ত সংখ্যক উদাহরণ ও অনুশীলনী। তৃতীয় শ্রেণির বা তদূর্ধ কোনাে শিক্ষাথী, যে নিজে নিজে পড়তে শিখেছে, এমন যে কেউ এই বইটির উদ্দিষ্ট পাঠক। যারা বইটি পড়বে তাদের মাঝেমধ্যে শিক্ষক-অভিভাবকদেরও সহায়তা প্রয়ােজন হবে। তবে অনুরােধ থাকবে যাতে তারা বইটির কোনাে সমস্যা বা অনুশীলনী পুরােটা সমাধান করে না দেন। বরং শিক্ষার্থীদেরকে নিজ থেকে ভাবতে উৎসাহিত করেন।
১৯৮৭ সালের ১ জানুয়ারি রাজশাহীতে জন্ম বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ ও লেখক সৌমিত্র চক্রবর্তীর। কাঞ্চননগর মডেল হাই স্কুল থেকে প্রাইমারি এবং ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। বই পড়ার নেশা ছোটবেলা থেকেই, আর এ বিষয়ে সবসময়ই উৎসাহ দিয়ে গেছেন তার বাবা-মা। তবে ক্যাডেট কলেজে পড়াকালে কলেজের লাইব্রেরিতে থাকা অনেক বিরল বইয়ের খোঁজ পেয়েছিলেন। সেসব বইয়ের মাঝে তাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করতো গণিতের বই। ফলে গণিতের প্রতি আগ্রহটা তার সহজাত, কিন্তু এর পাশাপাশি তিনি জীববিজ্ঞানকেও আপন করে নিয়েছিলেন। অপরদিকে ঝিনাইদহ সরকারি স্বাস্থ্য সহকারী প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ বাবা এবং ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের নার্সিং সুপারভাইজার মায়ের অনুপ্রেরণাও তাকে প্রভাবিত করেছে। তাই চিকিৎসক হওয়ার আশায় তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। কিন্তু গণিত এবং জীববিজ্ঞানের প্রতি ভালবাসা থেকে তিনি পাশাপাশি লেখালেখিও করছেন। সৌমিত্র চক্রবর্তীর বই লেখার ধাঁচ অনেকটা গবেষণাধর্মী, এছাড়াও বাংলায় সহজভাবে তিনি গণিত এবং বিজ্ঞানের গুরুগম্ভীর বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে থাকেন যাতে করে সাধারণ পাঠকের কাছে বিষয়গুলো সহজ হয়ে দাঁড়ায়। সৌমিত্র চক্রবর্তী এর বই সমূহ এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ‘প্রাণের মাঝে গণিত বাজে’, ‘জীবনের গল্প’, ‘জীবনের গাণিতিক রহস্যঃ পপুলেশন জেনেটিক্স ও গেইম থিওরি’, ‘গণিতের সাথে বসবাস’, ‘খণ্ড ক্যানভাস’ ইত্যাদি। বই লেখার পাশাপাশি তিনি আরো কিছু কাজের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন। তিনি একাধারে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের একাডেমিক কাউন্সিলর, বাংলাদেশ জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড কমিটির কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী এবং ময়মনসিংহ প্যারালাল ম্যাথ স্কুলের উদ্যোক্তা। তাঁর সময় কাটে অবসরে বই পড়ে ও প্রোগ্রামিং চর্চা করে। ২০২১ সালে "করোনা বৃত্তান্ত" বইয়ের জন্য বাংলা একাডেমি কর্তৃক "হালীমা-শরফুদ্দীন বিজ্ঞান লেখক পুরস্কার" -এ ভূষিত হয়েছেন।