"সমুদ্র বিলাস"বইটির প্রথমের কিছু কথা: রাত তিনটার দিকে তৌহিদের কি যেন হল। বুকে চাপ ব্যথা, ঠিকমত নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। – কি হচ্ছে ? সেকি মরে যাচ্ছে? ‘মৃত্যু কি এরকম হয়? তৌহিদ ক্ষীণ স্বরে ডাকল, রিমি এই রিমি? রিমি এই বিছানায় তার সঙ্গেই ঘুমুয়। শুধু আজ ঘুমুয়নি। আজ দুপুরে দুজনের মধ্যে প্রচন্ড রকমের ঝগড়া হয়েছে। সেই ঝগড়ার পরিণতিতে রিমি ঘুমুচ্ছে বসার ঘরের সােফায়। মশারী খাটানাে যায় নি। দুটি মসকুইটো কয়েল জ্বালানাে হয়েছে। তার উৎকট গন্ধে মশাদের কিছুই হচ্ছে না দম বন্ধ হয়ে আসছে রিমির। তার একবারেই ঘুম হচ্ছে না, বার বার ইচ্ছে করছে শােবার ঘরে মশারীর ভেতর চলে যেতে। যাওয়া যাচ্ছে না ও ঘরে যাওয়া মানে পরাজয় স্বীকার করে নেয়া। তৌহিদ আবার ডাকল, রিমি। এই রিমি। তৌহিদের গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যে রিমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল - তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কী হয়েছে? বাতি জ্বালাও আমি মরে যাচ্ছি। রিমির সব এলােমেলাে হয়ে গেল। এইঘরের সুইচ বাের্ডটা কোথায়? সে সােফার কোন দিকে মাথা দিয়েছে? জালানা যে দিকে সেই দিকে? এত অন্ধকার কেন চারপাশে? সােফা থেকে নামার সময় ধাক্কা লেগে টেবিলে রাখা গ্লাস ঝন ঝন শব্দে ভাঙ্গল। পাশের ঘর থেকে রিমির শাশুড়ি জোবেদা খানম বললেন, ও বৌমা কি হয়েছে, হয়েছে কি? ভাগ্যিস তিনি কথা বলছিলেন, তার কথা শুনেই রিমি দিক ঠিক করল। সুইচ বাের্ড খুজে পেল। বাতি জ্বালাল। জোবেদা খানম এক নাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছেন - ও বৌমা কি ভাঙ্গল ? ঘরে চোর ঢুকল না- কি দেখ । ভাল করে দেখ। খাটের নীচটা দেখ।। রিমি তাঁর শাশুড়ির কোন কথার জবাব দিল না । সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তৌহিদের দিকে, বােঝাই যাচ্ছে এই মুহূর্তে শ্বাস নেয়ার পুরাে প্রক্রিয়াটা তৌহিদের কাছে অত্যন্ত কষ্টকর। তার ঠোট কেমন নীলচে হয়ে গেছে । চোখ ঘােলাটে। তৌহিদ বিড় বিড় করে বলল, জানালা খুলে দাও, ফ্যান ছাড়।
বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তী হুমায়ূন আহমেদ। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম স্থান দখল করে আছেন। একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও নাট্যকার এ মানুষটিকে বলা হয় বাংলা সায়েন্স ফিকশনের পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি বেশ সমাদৃত। বাদ যায়নি গীতিকার কিংবা চিত্রশিল্পীর পরিচয়ও। সৃজনশীলতার প্রতিটি শাখায় তাঁর সমান বিচরণ ছিল। অর্জন করেছেন সর্বোচ্চ সফলতা এবং তুমুল জনপ্রিয়তা। স্বাধীনতা পরবর্তী বাঙালি জাতিকে হুমায়ুন আহমেদ উপহার দিয়েছেন তাঁর অসামান্য বই, নাটক এবং চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের বদৌলতে মানুষকে করেছেন হলমুখী, তৈরি করে গেছেন বিশাল পাঠকশ্রেণীও। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’ দেখতে দর্শকের ঢল নামে। এছাড়া শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, ঘেটুপুত্র কমলা প্রভৃতি চলচ্চিত্র সুধীজনের প্রশংসা পেয়েছে। অনন্য কীর্তি হিসেবে আছে তাঁর নাটকগুলো। এইসব দিনরাত্র, বহুব্রীহি, আজ রবিবার, কোথাও কেউ নেই, অয়োময়ো আজও নিন্দিত দর্শকমনে। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের জনক তিনি। রচনা করেছেন নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, জোছনা ও জননীর গল্পের মতো সব মাস্টারপিস। শিশুতোষ গ্রন্থ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রচনা, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমূহ এর পাঠক সারাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে। হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমগ্র পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিতও হয়েছে। সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), একুশে পদক (১৯৯৪), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূধন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮), শিশু একাডেমি পুরস্কার, জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদকসহ নানা সম্মাননা। হুমায়ূন আহমেদ এর বই, চলচ্চিত্র এবং অন্যান্য রচনা দেশের বাইরেও মূল্যায়িত হয়েছে৷ ১৯৪৮ সালের ১৩ই নভেম্বর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলায় কুতুবপুরে পীরবংশে জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের বেলভ্যু হাসপাতালে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। গাজীপুরে তাঁর প্রিয় নুহাশ-পল্লীতে তাঁকে সমাহিত করা হয়।