মানুষের আদিবৃত্তি হলো রহস্যরসাপ্লুত গল্প শোনা। মানুষ রহস্যময় ঘটনা শুনতে চায়, রহস্য উদ্ঘাটন করতে চায়। বিশ্ব সাহিত্যে রহস্যগল্পের ধারাটি বিপুল। রহস্যরোমাঞ্চ গল্প, ভৌতিক গল্প, ডিটেকটিভ গল্প ইত্যাদি রূপে প্রথিতযশারা যেমন সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন তেমনি কেউ কেউ শুধু রহস্যরোমাঞ্চ লিখেই বিখ্যাত হয়েছেন। বাংলাদেশের সর্বকালের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ভূমিকা এক্ষেত্রে ন্যূন নয়। ভিন্ন দেশের কাহিনী অনুবাদ, কখনোবা রূপান্তর, কখনোবা ছায়ামাত্র অবলম্বন করে তিনি অনেক রহস্যরোমাঞ্চ লিখেছেন। একই মলাটে তিন ভিনদেশি সেই ধরনেরই তিনটি গল্পকাহিনী-দি একসরসিস্ট, অমানুষ ও সম্রাট। তিনটি কাহিনীর পটভূমি, চরিত্র ও আবহমণ্ডল ভিনদেশীয় হলেও তা রচনার গুণে আমাদের বাংলা সাহিত্য ও জীবনের সঙ্গে একাঙ্গ হতে পেরেছে। হুমায়ূন আহমেদের লেখনীর যে বৈশ্যিষ্ট, ভাষার জাদু আর মানবচরিত্র নির্মাণের দক্ষতা তা তিনটি কাহিনীতেই সুষ্ঠুরূপ লাভ করেছে। বিশেষ করে হত্যাকারী, জিঘাংসাবৃত্তি আর অসদ্বৃত্তিপ্রবণ মানুষগুলিকে তিনি যেমন জীবন্ত করে তুলেছেন তেমনি মূল চরিত্রের মধ্যে সঞ্চারিত করে দিয়েছেন মানবতা, প্রেম এমনকি কাব্যপ্রীতিও। তিন ভিনদেশি গ্রন্থটি হুমায়ূন আহমেদকে শুধু শক্তিশালী লেখকরূপেই তুলে ধরে না, বরং পাঠকের রহস্যতৃষ্ণা, মানবতাবোধ ও নান্দনিকবোধকেও দীপ্ত করে।
বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তী হুমায়ূন আহমেদ। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম স্থান দখল করে আছেন। একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও নাট্যকার এ মানুষটিকে বলা হয় বাংলা সায়েন্স ফিকশনের পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি বেশ সমাদৃত। বাদ যায়নি গীতিকার কিংবা চিত্রশিল্পীর পরিচয়ও। সৃজনশীলতার প্রতিটি শাখায় তাঁর সমান বিচরণ ছিল। অর্জন করেছেন সর্বোচ্চ সফলতা এবং তুমুল জনপ্রিয়তা। স্বাধীনতা পরবর্তী বাঙালি জাতিকে হুমায়ুন আহমেদ উপহার দিয়েছেন তাঁর অসামান্য বই, নাটক এবং চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের বদৌলতে মানুষকে করেছেন হলমুখী, তৈরি করে গেছেন বিশাল পাঠকশ্রেণীও। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’ দেখতে দর্শকের ঢল নামে। এছাড়া শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, ঘেটুপুত্র কমলা প্রভৃতি চলচ্চিত্র সুধীজনের প্রশংসা পেয়েছে। অনন্য কীর্তি হিসেবে আছে তাঁর নাটকগুলো। এইসব দিনরাত্র, বহুব্রীহি, আজ রবিবার, কোথাও কেউ নেই, অয়োময়ো আজও নিন্দিত দর্শকমনে। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের জনক তিনি। রচনা করেছেন নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, জোছনা ও জননীর গল্পের মতো সব মাস্টারপিস। শিশুতোষ গ্রন্থ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রচনা, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমূহ এর পাঠক সারাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে। হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমগ্র পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিতও হয়েছে। সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), একুশে পদক (১৯৯৪), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূধন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮), শিশু একাডেমি পুরস্কার, জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদকসহ নানা সম্মাননা। হুমায়ূন আহমেদ এর বই, চলচ্চিত্র এবং অন্যান্য রচনা দেশের বাইরেও মূল্যায়িত হয়েছে৷ ১৯৪৮ সালের ১৩ই নভেম্বর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলায় কুতুবপুরে পীরবংশে জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের বেলভ্যু হাসপাতালে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। গাজীপুরে তাঁর প্রিয় নুহাশ-পল্লীতে তাঁকে সমাহিত করা হয়।