ঘোর অথবা অনন্ত তৃষার গল্প’ গ্রন্থে অবিরাম বয়ে চলে মানুষ-তার নানাবিধ আচরণ-ঈর্ষা ও প্রেম, বেঁচে থাকার বহুবিধ অনুষঙ্গ, আকস্মিকতা, শ্রেণিচেতনা কিংবা নিশ্চেতনাসমেত উপস্থিত হয়; সামন্তীয় সমাজ কাঠামোর নির্মম অভিঘাতে বিপর্যস্ত মানুষের নির্লিপ্ততা গল্পের বিষয় হয়ে আসে। জন্ম ও মৃত্যু-এই দুইয়ের মধ্যে আলোর কণার মতো আমাদের ক্ষুদ্র মানুষজীবন-একটিবারের জন্যে পাওয়া এই জীবন-দেশ, সমাজ, পরিপার্শ্ব ও বাস্তবতার কাছে সমর্পিত; এরমধ্যেই ব্যক্তি আবর্তিত হয় নিজের পরিমণ্ডলের সুখ-দুঃখ, পাওয়া, না-পাওয়ার আর্তিতে-সবকিছুর পর, ব্যক্তির জীবন নিজেরই কাছে আর সবকিছুর চেয়ে প্রিয় ও আরাধ্য। যদিও বাস্তবতার নিক্তি ব্যক্তিকে একের পর এক নতুনতর প্রেক্ষাপটে নিক্ষেপ করে। ব্যক্তি নিজেকে আবিষ্কার করে এক ঘোর থেকে আরেক ঘোরে। প্রবল সেই ঘোরগ্রস্ত মানুষেরা বেঁচে থাকতে চায়, ভালোবাসতে চায়; সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে সর্বস্ব পণ করতে চায়, সুখের অন্তহীন স্বপ্ন দেখতে চায়। মরীচিকাসম সুখ প্রকৃতপক্ষে আপেক্ষিক এক বস্তু বটে। তাই অনন্ত তৃষাই হয় অনিবার্য সত্য-সকল দীনতা, ক্ষুদ্রতা, হিংস্রতার পরও জীবনের অফুরন্ত বিস্ময়ের সামনে মানুষ নতজানু হয়। এসবই মাহবুব আজীজের গল্পের বিষয়-কোথাও সরাসরি, কোথাও অপ্রত্যক্ষ; এই লেখক সামান্য আড়ালে থেকে সত্যের সারাৎসার তুলে আনেন; অধিকাংশ সময় মৃদু অথচ সুতীক্ষ্ণ ও মর্মভেদী তার উচ্চারণ। ভাস্কর্যপ্রতিম আশ্চর্য গদ্যে মাহবুব আজীজ সমকালীন জীবন বাস্তবতার অভিনব আখ্যানের ডালা মেলে ধরেন। তার গল্পে বিচিত্র মানুষ ভিড় করে। যারা নানা টানাপড়েনের মধ্যেও জীবনকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে তুমুল বেঁচে থাকতে চায়। এখানে ভিড় করে অনিশ্চয়তা, আসে সামাজিক দুর্বিপাক, ঘন হয়ে আসে প্রতিকূলতা। আর এসবের মধ্যে অন্তরপ্রবাহের মতো ছড়িয়ে থাকে মাহবুব আজীজের গল্পের চরিত্রদের বেঁচে থাকবার অনন্ত তৃষা। সম্পর্কের আলোছায়া আর মানুষের বানানো সামন্তীয় সমাজ ও আভিজাত্যবোধের নির্মম মানসিকতার স্পর্শ আছে এই গ্রন্থে। আছে নদীতীরবর্তী জনপদের প্রান্তিক মানুষের আখ্যান। মাহবুব আজীজ অনিবার্য করে তোলেন জীবন ও জগতের তীব্র সত্যের ইঙ্গিত-সরাসরি নয়, শিল্পের আবরণে তিনি উপস্থাপন করেন পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা, একুশ শতকের প্রথমার্ধে জীবনযাপনের দহন ও আনন্দ; প্রেম ও বেদনা। গল্পে এই লেখক অনিবার্য করে তোলেন জীবন ও জগতের শাশ্বত সত্য-যা চিরকালীন জীবনতৃষ্ণার দলিল।