ভূমিকা রূপকথায় আছে হট্টমালার দেশের কথা। সেই দেশের জীবনের রূপ এবং হাসিকান্নার রীতিনীতি অদ্ভুত। কথক তাঁর কাহিনীকে বিশেষ এক বিস্ময়, কৌতূহল ও কৌতুকের রসে রসিত করার জন্য এক অবাস্তব দেশের রূপ কল্পনা করে নিয়েছেন। পৌরাণিকেরও এই রকমের এক-একটা অবাস্তব দেশ অথবা জগৎ আছে। ইন্দ্ৰলোক আছে, গন্ধর্বলোক আছে, বরুণালয় আছে। এসব জগতের প্রকৃতি ভিন্নতর এবং জীবনের রূপও ভিন্নতর। কোথাও চিরবসন্ত বিরাজিত, কোথাও চিরযৌবন। উপকথার কথকও এই ধরনের কাল্পনিকতার কৃতিত্বে কম যান না। তাঁরও ‘পরির দেশ' আছে। লৌকিক সুখ-দুঃখের ঘটনার সঙ্গেই বহু ও বিচিত্র অলৌকিক রহস্য মিশিয়ে কাহিনীকে আলোছায়ার মতো একটা মিশালি রূপ ও বিস্ময়ের রস দান করে উপকথা। আধুনিক যুগের আশ্চর্য কাহিনীর রচয়িতারাও নানারকমের 'আজব দেশ' কল্পনা করেছেন। কেউ সৃষ্টি করেছেন লিলিপুটের দেশ, কেউ বা অন্য কোনো অদ্ভুতের রাজ্য। ‘কিংবদন্তীর দেশ’ অবশ্য এই ধরনের নিছক কল্পনাসম্ভব কোনো দেশ নয়। কিংবদন্তীর দেশটা খুবই বাস্তব ও সত্য। কারণ কিংবদন্তীর ঘটনাস্থল স্বচক্ষে দেখা যায়। কিংবদন্তীগুলি হল অর্ধেক ইতিহাস আর অর্ধেক কল্পনা। অবশ্য কল্পনামিশ্রিত পৌরাণিকতার রূপ ও পরিচয় নিয়ে এক বিশেষ শ্রেণীর কিংবদন্তীও আছে। প্রত্যেক দেশেরই জনসমাজে শত- সহস্র কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। কিংবদন্তীও জাতির বিশেষ এক শ্রেণীর কথাসাহিত্য, যদিও পুরাণ, রূপকথা, ব্রতকথা ও উপকথার মতো বিশেষ কোনো ধরনের বর্ণনভঙ্গী কিংবদন্তীর মধ্যে পাওয়া যায় না। অরণ্যের নিভৃতে সমাশ্রিত পুষ্পকুঞ্জের মতোই কিংবদন্তীগুলির রূপ যেন প্রাণের এক সহজ আবেগে নিজেকে প্রকাশ করেছে। বাগানের পুষ্পকুঞ্জের অনুরূপ কোনো পারিপাট্য এদের নেই, কারণ এরা কোনো দক্ষ মালির হাতের সেবায় ও যত্নে লালিত নয়। কিন্তু বর্ণ ও সৌরভের কোনো অভাব নেই। এমন বহু কিংবদন্তী আছে যেগুলি যথার্থ রসোপেত ও পুনর্গঠিত এক একটি কাহিনী পুরাণ, রূপকথা, উপকথা, ব্রতকথা, এমন কি আষাঢ়ে গল্পেরও মতো বিশেষ কোনো একটি সাহিত্যোচিত প্রকাশভঙ্গী কিংবদন্তীগুলির নেই। মিথ, লেজেন্ড, ফেবল ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণীর কথাসাহিত্য তাদের কাহিনীগত বিষয় এবং কল্পনাধর্মের বৈশিষ্ট্যের কারণে শুধু নয়, কালক্রমে বিশেষ এক একটি গঠনরীতি লাভ করার কারণেও বিশেষ বিশেষ সাহিত্যরূপ অর্জন করেছে। কিংবদন্তী এরকম কোনো বিশেষ গঠনরীতি আজও লাভ করেনি এবং কোনোকালে লাভ করবে বলেও মনে হয় না। কিংবদন্তীগুলি হল বাস্তব ও কল্পিত ঘটনার খণ্ড খণ্ড অবয়ব, অবিন্যস্ত, অগ্রথিত ও সৌষ্ঠববিহীন, কথাশিল্পের কাঁচা মাল। কিংবদন্তীর সৃষ্টিরও বিরাম নেই। কিংবদন্তী অতীতের বিশেষ কোনো যুগের সৃষ্টিও নয়। ঘটনা অতীত হয়ে যায়, ইতিহাস তার দাগ রেখে দিয়ে যায় ভগ্ন দুর্গ-প্রাকারের একটি ইষ্টকখণ্ডে, একটি দীর্ঘিকার সোপানে অথবা প্রাসাদের ভগ্নস্তূপে। কোথাও বা সে চিহ্নও থাকে না। কিন্তু ইতিহাসের সেই সব ঘটনার একটি অশরীরী রূপ জীবন্ত করে রাখে কিংবদন্তী।
তিনি একজন ভারতীয় বাঙালি লেখক ও বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক। বিহারের হাজারীবাগে ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯০৯ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। লেখক জীবনের প্রথমে আনন্দবাজার পত্রিকাতেও সাংবাদিকতা করেছেন। হাজারিবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজের ছাত্র ছিলেন। বিশিষ্ট দার্শনিক ও গবেষক মহেশ ঘোষের লাইব্রেরীতে পড়াশোনা করতেন। প্রচুর খ্যাতি ও পুরস্কারের ডালি সহ তার লেখালেখির কালপর্ব ১৯৪০ থেকে ১৯৮০। এর মধ্যে রচনা করে গেছেন সমাজের হিন্দুয়ানী কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। লড়েছেন কলম যুদ্ধ। প্রথম গল্প 'অযান্ত্রিক', এরপর 'ফসিল'। তাঁর আর একটি বিখ্যাত গল্প 'থির বিজুরি'। এছাড়াও, জতুগৃহ, ভারত প্রেমকথা (মহাভারতের গল্প অবলম্বনে রচিত), তিলাঞ্জলি (১৯৪৪), গঙ্গোত্রী (১৯৪৭), ত্রিযামা (১৯৫০), ভালোবাসার গল্প, শতকিয়া (১৯৫৮) প্রমূখ। এই লেখাগুলোই তার প্রাণের কথা বলে গেছে কালের পরিক্রমায়।