গেসি দ্বীপে সমুদ্রের ধারেই স্যামসন গ্রাম। আজ গ্রামে বড় ধুমধামের দিন। একে খ্রিস্টমাসের উৎসব, তাতে আবার আজ এখানে প্রচুর তুষারপাত হয়েছে। ইংলন্ড আর ফ্রান্সের মাঝামাঝি সমুদ্রের বুকে যে-কয়টি ছোট ছোট পার্বত্য দ্বীপ আছে, গেসি তাদেরই অন্যতম। শীতকালে এ-অঞ্চলে তুষারপাত একটু কম হয়, কোনদিন বরফ পড়লে হৈচৈ-এর আর অবধি থাকে না। সবেমাত্র পুবের কুয়াশ কুয়াশার আবরণ ভেদ" করে সূর্যের আলো এসে পড়েছে স্যামসন গ্রামের পথের উপরে। বন্দর থেে বন্দর থেকে বরাবর সমুদ্রের ধার দিয়ে যে- পথটা গ্রামের ওদিকে শেষ পর্যন্ত চলে গেছে, সেটা আজ বরফে একেবারে একাকার হয়ে আছে। খুব কনকনে শীত। ' বেলা প্রায় ন'টার কাছাকাছি। তবু রাস্তাটিতে আজ লোক চলাচল তেমন নাই ! * এই নির্জন প্রায় রাস্তা দিয়ে তিনটি মাত্র প্রাণী হেঁটে চলেছে—একটি বালক, একটি যুবক, অপরটি তরুণী। প্রথমে বালক, তারপর তরুণী, সবশেষে চলেছে যুবক। প্রত্যেকেই ছাড়াছাড়ি হয়ে দূরে দূরে পথ চলছে— স্পষ্টই মনে হয়, এদের পরস্পরের মধ্যে কোনই সম্পর্ক নাই। বালকটির বয়স প্রায় আট বছর; সে মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে কৌতূহলপূর্ণ দৃষ্টিতে চারিদিকের এই অপূর্ব শ্বেত-শোভার পানে তাকাচ্ছিল। যুবক ও তরুণীটি উভয়েই আসছিল গ্রামের সেন্ট পিটার গির্জার দিক থেকে। যুবকের চেহারায় শ্রমিক ও নাবিকের মাঝামাঝি একটা ছাপ রয়েছে। তার পরনে ক্যাম্বিসের একটা ঢিলে পায়জামা, গায়ে বাদামী রঙের মোটা গেঞ্জি। খুব সাদাসিধে ধরনের পোশাক; উৎসব-দিনের বিশেষ বেশভূষার কোন লক্ষণই তাতে নাই। তরুণীটি কিন্তু ঠিক তার বিপরীত। তার সাজসজ্জা ও বেশবিন্যাসে পারিপাট্যের অভাব ছিল না। আজকের দিনে গির্জায় যাবার জন্যেই সে যেন বিশেষভাবে সেজেগুজে বেরিয়েছে। বেশ স্বচ্ছন্দ গতি।
ভিক্টর মারি হুগো ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৮০২ সালে ফ্রান্সে জন্মগ্রহন করেন। নেপোলিয়ন বোনাপার্টের বিশাল সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তার সন্তান ছিলেন তিনি। একাধারে সাহিত্য এবং রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। ফ্রান্সে সা¤্রাজ্য আইন থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিবর্তিত হওয়া এবং সেই প্রক্রিয়ার নানান উত্থান-পতনে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্যারিসে বসবাসরত ভিক্টর হুগো তরুণ বয়সেই তার কবিতা, কল্পকাহিনি এবং নাটকের জন্য বিখ্যাত এবং কখনো কুখ্যাতও হয়েছিলেন। ১৮৪৫ সালে, তার বিখ্যাত গ্রন্থ লা মিজারেবল লেখার সময়, রাজা তাকে ফ্রান্সের উচ্চকক্ষের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করেন। আইনসভার সর্বোচ্চ দলের সঙ্গে তাকে সম্পৃক্ত করা হয়। তিনি সেখানে সবার জন্য বিনা খরচে লেখাপড়া, সার্বজনীন ভোটাধিকার এবং মৃত্যুদণ্ডের বিলুপ্তির ব্যাপারে কাজ করা শুরু করেন। ১৮৪৮ সালে যখন রাজ্যে উন্নতির জোয়ার স্পষ্টভাবে কড়া নাড়ছিল, তিনি লা মিজারেবল লেখা বন্ধ করে রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু ১৮৫১ সালে যখন দেশের প্রেসিডেন্ট নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন, হুগোর রাজনৈতিক চেতনার বিরোধিরা তাকে বৃটিশ চ্যানেলের একটি দ্বীপে নির্বাসনে বাধ্য করে। নির্বাসনে থেকেই ১৮৬০ সালে তিনি আবার লা মিজারেবল লেখার কাজে হাত দেন এবং পরের বছর উপন্যাসটি শেষ করেন। ১৮৭০ সালে সম্রাটের পতন হলে হুগো ফ্রান্সে ফেরত আসেন, যেখানে তাকে গণতন্ত্রের মানসপূত্র হিসেবে বিপুলভাবে সম্মানিত করা হয়। ২২ মে ১৮৮৫ সালে ভিক্টর হুগোর মৃত্যুর পরে ফ্রান্সের রাস্তায় তার কফিন বয়ে নেবার সময়ে বিশ লাখ মানুষের ঢল নামে। সেদিন ফ্রান্সের জনগণ যতভাবে সম্মান জানানো সম্ভব, জানিয়ে তার শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন করেন।