"রোহিঙ্গা জাতির ইতিকথা" বইটির প্রথম ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ হরিণের শত্রু মাংস হাতির শত্রু দাঁত। নারীর শত্রু রূপ-যৌবন রােহিঙ্গার শত্রু জাত। এ রােহিঙ্গা শব্দটি বর্তমান বিশ্বে সর্বাপেক্ষা আলােচিত এক নাম। রাষ্ট্রহীন ও নাগরিকত্বহীন রােহিঙ্গারা আজ বিপন্ন ও বিলুপ্তির পথে। রাষ্ট্র ও সমাজ এদেরকে পরিকল্পিতভাবে অর্ধশতাব্দী ধরে বর্বর নির্যাতন ও পাশবিক অত্যাচারের মাধ্যমে ধ্বংসের শেষ পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। সমাজের তলের তল এ ভূমিপুত্ররা আজ মাতৃভূমিতেই মরতে বসেছে। ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-জাত-পাতই রােহিঙ্গাদের শত্রু হয়ে দেখা দিয়েছে। বর্তমানে পাশবিকতায় মায়ানমারের (সাবেক বার্মা) সামরিক সরকারের চেয়ে অং সান সুচির গণতান্ত্রিক সরকার ছাঁপিয়ে গিয়েছে। কারণ এ সরকার সুকৌশলে অশিক্ষিত-অসহায় রােহিঙ্গাদের জন্মভূমির নামই বার বার বদলায়নি, বরং জন্ম-বর্ণ পরিচয়ে সংকট ও সংক্রামণ ঘটিয়েছে। এ্যাথনিক ক্লিঞ্জিং-র গণধর্ষণের মাধ্যমে রক্তে দূষণ এবং আর্থ-স্কর্চড স্ট্র্যাটেজির পােড়ামাটি নীতির মাধ্যমে তাদেরকে বসতভিটার মাটি ও মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করে উন্মুল-উদ্বাস্তুতে পরিণত করে ফেলেছে। প্রাণ বাঁচাতে সাত লক্ষাধিক রােহিঙ্গারা বানের পানিতে ভাসা কচুর মতাে ভেসে ভেসে প্রতিবেশী বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। বনপােড়া হরিণের মতাে এরা প্রাণভয়ে দিগ্বেদিক ছুটে চলছে। হাঁটাপথে ও ভাসাপথে আসা রােহিঙ্গাদের কান্ত মিছিল আসা এখনাে অব্যাহত রয়েছে। মানবতার এ লাঞ্ছনা-অপমান এবং পরাজয়-পরাভবে বিশ্ববিবেক আজ যুগপত্তাবে প্রশ্ন ও হুমকির সম্মুখীন। মায়ানমার সরকারের এ নজিরবিহীন বর্বরতা বল্গাহীন ঘােড়া ও বন্য হাতির মত্ততাকেও হার মানায়। যা ফ্যাসিবাদী হিটলারকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। কারণ হিটলার ইহুদিদের ‘ইহুদি' বলেই হত্যা করেছে কিন্তু মায়ানমারের সরকার রােহিঙ্গাদের জাতি-পরিচয় পাল্টে দিয়ে ‘রাখাইন মুসলিম’ ও ‘বাঙালি সন্ত্রাসী' বলে নির্বিচারে হত্যা করে চলছে। এ পীড়ন থেকে হিন্দুরাও বাদ পড়ছে না। মধ্যযুগের রােমান সাম্রাজ্যের হােমােসাসের নিকৃষ্ট দাসদের চেয়েও এদের করুণ অবস্থা। এক অদৃশ্য কারাগারে বন্দি হয়ে নব্য দাসত্বের জোয়াল কাঁধে করে কলুর বলদের মতাে রােহিঙ্গারা তিলে তিলে হারিয়ে যাচ্ছে। রােহিঙ্গাদের এমন পরিণতির নেপথ্যে রয়েছে ভয়ংকর বৌদ্ধ মৌলবাদ, রক্তাক্ত ইতিহাস এবং প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাের পুঁজিনির্ভর ভূ-রাজনীতি। পুঁজি আর প্রযুক্তির পৈশাচিক নেশা বার্মা সরকারকে পেয়ে বসেছে। সরকারের ক্রমাগত আগ্রাসনে রােহিঙ্গারা আজ গ্লানিতে জরজর, অপমানে ভূ-শায়ী, নিপীড়নে নির্জীব, শােষণে নিঃস্ব, বঞ্চনায় বাকরুদ্ধ, মৃত্যুতে মলিন, হিংস্র হত্যায় হিঙুল এবং বেঁচে থাকার মরণপণ জাপ্টাজাল্টিতে ক্লান্ত আর অবসিত।