"সুনীল বাংলাদেশ" বইটির প্রথম ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায় বারেবারেই ঘুরে ফিরে এসেছে বাংলাদেশ। সত্যি বলতে কী, বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন সজাগ আগ্রহ ওপার বাংলার আর কারাে মধ্যেই দেখা যায়নি। তার বাংলাদেশ বিষয়ক প্রায় ৮০টি লেখার সংকলন এই বই। খ্যাতির তুঙ্গে থাকা হাসান আজিজুল হক, শামসুর রাহমানকে নিয়ে যেমন লিখেছেন; আবার তখনাে পর্যন্ত অখ্যাত হুমায়ূন আহমেদের প্রথম বইটি নিয়েও লিখেছেন। সামস্ রাশীদকে নিয়ে যখন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত কোনাে সমালােচকই লেখেননি, তার উপল উপকুলে নিয়ে মনােজ্ঞ একটা আলােচনা করেছেন। এই বাংলার কবিতা, গল্প, উপন্যাস নিয়ে তাঁর একাধিক লেখা আছে, আলাদা করে বাংলাদেশের গদ্য নিয়ে আছে ধারাবাহিক রচনা। আর একাত্তরের পুরাে সময় জুড়ে প্রতিমাসেই লিখেছেন একাধিক রচনা। সেসব লেখার কোনােটার বিষয় আঁদ্রে মালরাের চিঠি, কোনােটায় কিভাবে অ্যালান গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশাের রােড’ লেখার অনুঘটক হয়ে উঠলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তার বিবরণী আছে বারবার বাংলাদেশে ঘুরে যাওয়ার বিত্তান্ত, বাংলাদেশের তিন নদীর রূপ বর্ণনা। আর আছে বাংলাদেশ নিয়ে কবিতা, ছড়া আর গল্প। এসব লেখার একটা বড় অংশ এতদিন পত্রিকার পুরনাে পাতায় বন্দি হয়েছিল। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রধান একজন লেখকের বাংলাদেশ বিষয়ক লেখাগুলােকে এক করে পাঠকের হাতে তুলে দিতে পেরে আমরা গর্বিত।
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।