বিকেল শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু এখনো ভালো করে সন্ধে নামে নি। আকাশে এক রকমের মন্থর আলো। এই খানিকটা সময় চেনা শহরের সব দৃশ্যই একটু বদলে যায়, সব কিছুতে একটু রহস্যের স্পর্শ লাগে, এই সময়ে মানুষের মুখ দেখলে তার ভেতরটা ঠিক চেনা যায় না। গড়িয়াহাটের মোড়ে এখন বেশ ভিড়। শাড়ীর দোকানে, ফুলের দোকানে, সন্দেশের দোকানে লটারির টিকিটের দোকানে জমজমাট ভিড়। অনেকগুলো মোটর গাড়ি থেমে আছে রাস্তার দু' পাশে, অনেক লোক অপেক্ষা করছে ট্রাম বাসের জন্য- সহজে উঠতে পারবে না জেনেও। কেউ কেউ হেঁটে যাচ্ছে ব্যস্ত ভাবে, ট্যাক্সিগুলো উসখুস করছে ট্রাফিকের লাল আলোর সামনে, আবার কোথাও কোথাও একটি করে ছোটোখাট দল দাঁড়িয়ে জটলা করছে, তাদের কোনো ব্যস্ততা নেই। এখন এখানে যত নারী তাদের কারুরই শাড়ীর ডিজাইন এক রকম নয়, রামধনুর সাত রং টুকরো টুকরো করে ছড়ানো। যে-সব যুবকেরা এদিকে দাঁড়ানো তাদের প্যান্টের ইস্ত্রি নিখুঁত, শার্টের কলার খাড়া, যদিও অনেকেই বেকার। প্রৌঢ়দের ধুতি-পাঞ্জাবি শুভ্র নিপাট, কোথাও কোনো জটিলতা নেই- শুধু কমা সেমিকোলনের মতন এখানে ওখানে কিছু ভিখিরি ছড়ানো। আর থামে হেলান দেওয়া শতচ্ছিন্ন পোশাকে একটি পাগল। এই ভিড়ের মধ্যে থেকে আমরা তিনজনকে আলাদা করে বেছে নিলাম। তিনটি নারী। এইমাত্র ওঁরা একটি ভ্যারাইটি স্টোর্স থেকে বেরুলেন। একজন বর্ষিয়সী, চওড়া পাড়ের শান্তিপুরী শাড়ী পরে আছেন, বয়সে চল্লিশের এপারে না ওপারে ঠিক বোঝা যায় না, শরীরের বাঁধুনি আছে এখনো, ঈষৎ ভারীর দিকে, তবে সংসারের কর্ত্রী হতে গেলে ঠিক যতটা মানায়। এঁর হাতে একটি বড় ব্রাউন প্যাকেট।
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।