"ডেল কার্নেগি রচনাসমগ্র" বইটি সম্পর্কে কিছু কথাঃ সহজাত চিন্তাশক্তি আর সৃজনশীল আবেগের বৈচিত্র্য মানুষের স্বপ্ন ও কল্পনাকে রঙিন করে তােলে। ব্যক্তির হৃদয় হয়ে ওঠে জ্বলন্ত চুলার মতাে, যা তার স্বপ্নকে ছাই করে দেয়। মানুষ তার নিজস্ব যুক্তি দিয়েই প্রতিষ্ঠা করেছে প্রথা, বিধি-বিধান। মহৎ চিন্তা মানুষকে কতটা মহৎ করতে পারে, এর বড় প্রমাণ তলস্তয়। লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়তা থাকলে মানুষ তার পাহাড়ের সমান সুউচ্চ স্বপ্নকে বাস্তব করে তুলতে পারে। ভবঘুরে শ্রমিক হয়ে উঠতে পারে ধনকুবের। কিন্তু এই জন্য অবচেতন মনের ঘুমন্ত দৈত্যটাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। শেকসপিয়রের হ্যামলেট নাটকের প্রধান চরিত্র হ্যামলেটের মধ্যে এই শক্তির উজ্জীবন প্রকাশ ঘটেছে। হ্যামলেটের বাবার মৃত্যুর পর শােকের ছায়া কাটাবার আগেই তার মা হঠাৎ বিয়ে করে ফেলে। বিষয়টি তখনই উদ্বিগ্নের কারণ হয়ে দাড়ায়। যখন তার আসল পিতার চেয়ে সৎপিতা সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের। তার আসল পিতা ছিল খুবই ভালাে। কিন্তু সৎপিতা ছিল খুবই খারাপ। হ্যামলেট সে কথাই তার মাকে জানিয়ে দেয়। সে জানিয়ে দেয়, দুজনের মধ্যে পার্থক্য হাইপেরিয়ান আর স্যাটারের মতােই। হাইপেরিয়ান হচ্ছেন সূর্য-দেবতা-আলােকোজ্জ্বল, জীবন দায়ী আর স্বাস্থ্য দায়ী। সকল ভালাে জিনিস তার দান। অন্যদিকে স্যাটার হচ্ছে সকলেরই ঘৃণার পাত্র। ডেল কার্নেগি হাইপেরিয়ান ও স্যাটারের চরিত্রের অবতারণার মাধ্যমে মানুষের মনে শুভ শক্তির অভ্যুদ্বয় কামনা করেছেন। তিনি সারা জীবন মানুষের আত্মশক্তি ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন বিষয়ের উপর গবেষণা করেছেন। কার্নেগির গবেষণা কর্মগুলাে পরশ-পাথরের মতাে কাজ করেছে। তাই তার লেখাগুলাে এখনাে আগের মতােই প্রাসঙ্গিক।
ডেল ব্রাকেনরিডজ কার্নেগী, এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে ২৪ নভেম্বর, ১৮৮৮ সালে জন্ম নেওয়া এই আমেরিকান লেখক তাঁর আত্ম-উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও বইয়ের পাতায় আজও বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এক নাম। সেলফ-ইম্প্রুভমেন্ট, সেলসম্যানশিপ, করপোরেট ট্রেনিং, পাবলিক স্পিকিং, ও ইন্টার পার্সোনাল স্কিল এর মতো দারুণ সব প্রশিক্ষণের উদ্ভাবন ও এসব বিষয়ে লেখা ডেল কার্নেগী এর বই সমূহ আশার আলো দেখিয়েছে অসংখ্য হতাশাচ্ছন্ন মানুষকে। মিসৌরিতে দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়ার দরূণ বালক বয়স থেকেই কাজ করেছেন ক্ষেতখামারে। এর মাঝেও ওয়ারেন্সবার্গের সেন্ট্রাল মিশৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন। কলেজ শেষে জীবিকার তাগিদে বেকন, সাবান এবং লার্ড (শূকরের চর্বি মিশ্রিত করা) তৈরির কাজও করতে হয় আর্মর অ্যান্ড কোম্পানির জন্য। ফার্মের প্রধান হিসেবে অনেক সাফল্য লাভ ও ৫০০ ইউএস ডলার সঞ্চয়ের পর ১৯১১ সালে বহুদিনের লালিত স্বপ্ন অধ্যাপক হওয়ার জন্য বিক্রয় সেবার কাজটি ত্যাগ করেন তিনি। কিছু ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা ঝুলিতে নিয়ে যখন ওয়াইএমসিএ- এর ১২৫ নম্বরে বাস করতে শুরু করেন, তখনই পাবলিক স্পিকিং এর ধারণাটি মাথায় খেলা করে কার্নেগীর। সেই সময় মোট লভ্যাংশের ৮০% শতাংশের বিনিময়ে ওয়াইএমসিএ এর পরিচালকের কাছে শিক্ষা প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এভাবেই ১৯১২ সাল থেকে কার্নেগী কোর্সের যাত্রা শুরু হয়। পুরো আমেরিকাবাসীর কাছে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির পথ হয়ে উঠে তার পদ্ধতি। ডেল কার্নেগী এর বই সমগ্র এর মধ্যে ‘হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স’ বইটিকে তার সেরা অবদান হিসেবে ধরা হয়। প্রথম প্রকাশের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই যার ১৭তম মুদ্রণও প্রকাশ করতে হয়েছিলো। ডেল কার্নেগী এর লেখাগুলো বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। ‘বিক্রয় ও জনসংযোগ প্রতিনিধি হবেন কীভাবে’, ‘বন্ধুত্ব ও সম্পদ লাভের কৌশল’, ‘বড় যদি হতে চাও’, ‘ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও সাফল্যের সহজ পথ’ এমন নানা নামের অনূদিত ডেল কার্নেগী বাংলা বই অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে বাংলাভাষী পাঠকদেরও। ডেল কার্নেগী শ্রেষ্ঠ রচনাসমগ্র এর মধ্যে আরও আছে ‘দ্য বায়োগ্রাফি অব আব্রাহাম লিংকন’, ‘ফাইভ মিনিট বায়োগ্রাফিস’ এবং ‘বিশ্বায়নের পটভূমি’। ১ নভেম্বর, ১৯৫৫ সালে আমেরিকান এই অধ্যাপক মৃত্যুবরণ করেন।