‘ঐতিহ্যের কিতাব লিখি একালে বাঙলা আসীন হয় বাখানি বোলে \’ এই প্রকাশনায় অন্তর্ভুক্ত বাংলার বহুদর্শী ঐতিহ্যের ‘দশদিশি’ আখ্যান। প্রজ্ঞায়িত ঐতিহ্যের অনুষঙ্গে কথারা হয় দেশমাতার কথা। সে দেশ যা লোকায়ত তাৎপর্যে লিপ্ত। মৃৎশিল্প, নকশি পিঠা, গয়না বড়ি, তাঁত-তাঁতি তথা বয়ন, মসলিন, মাকু, শারদ শিউলি, শীতপুরাণ, হাট, পান সুপারি বিষয়ে যতœগভীর দৃষ্টির বাখান আছে এ গ্রন্থে। অভিবাসী এই শিল্পী-গবেষক-লেখকের ফিরে দেখা নিজের আয়োজন প্রয়োজনে সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজে। যে মেজাজে ধরাছোঁয়া থাকে শিল্পদৃষ্টির নানা খুঁটিনাটি। অতি অনায়াসে অনবদ্য বর্ণন ও প্রকাশে বাংলার বৈভব শতধা উচ্চকিত। বাংলার লোককৃষ্টি সঞ্জাত সমাজ ঐতিহ্যের এই বাখানচরিতে ধরা রয়েছে লোকায়ত সৃষ্টিশৈলীর টুকিটাকি সমেত। যা বঙ্গজ কারু ঐতিহ্যের কাঠামো অন্বিষ্ট। সেসব স্মৃতি কথা, স্বপ্ন কথা, গল্প কথারা বাংলার ঐতিহ্যের কাহিনি শোনায়। এমন এক ঐতিহ্যের যা সভ্যতারও বুঝি অগ্রজ! মুখর ঐতিহ্যের কথা সব। সমবায়ী গ্রামসমাজ উৎসারিত এহেন ‘দশদিশি’ আখ্যান এই বিনাশের কালে ঐতিহ্যপানে দৃষ্টিক্ষয়ের ব্যামোর যথাযথ দাওয়াই হয়ে উঠতে পারে। লেখকের বিনীত আর্জিÑÑ ‘দৃঢ়ভাবে এইবারে ইচ্ছিলুম হৃদয় ঐতিহ্যের বাখান শুনো হইয়া সদয় \’
স্কুলশিক্ষক বাবা ও গৃহকত্রী মায়ের চতুর্থ সন্তান। ছােটবেলায় দেখা ‘মা’ আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন সর্ববিশারদ, যার শিল্পসুষমা ছিল বিচিত্র কারুবাসনা ঘিরে। একদিন মায়ের শস্য ও কারুবাসনার সংসার থেকে ‘বিদ্যাবাসনার নিমিত্তে ঘর ছাড়তে হলাে নাবালক বয়সে অবধারিত বিপত্তি এড়িয়ে, ডিঙিয়ে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক, পথেঘাটে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষা গ্রহণ। কলাভবন, বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন, ভারত থেকে তন্তুকলা তথা বয়নচিত্র ও ভাস্কর্য (ট্যাপেস্ট্রি ও ফাইবার স্কাল্পচার) বিষয়ে স্নাতকোত্তর। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করেছেন কয়েক বছর। বাংলার চারু-কারু অনুষঙ্গ নিয়ে তাঁর নিত্যভাবনার পাঁচালি, যার মধ্যে বাংলার বয়ন ও কারিগর পেশার অন্ত্যজদের নিয়ে সুলুকসন্ধানে বিশেষ উৎসাহী। ফলে এ সংক্রান্ত নিরন্তর গবেষণা লেখালেখি । তচর্চা, সন্তানদ্বয় ‘বয়ন’ ও ‘বৈভব’-এর যত্ন-আত্তি আর ‘টানাপােড়েন’ সংগত করা তাঁর নৈমিত্তিকযাপন নৈবেদ্যস্বরূপ। দীর্ঘ অভিবাসী জীবনে জীবিকার জন্য সার্বক্ষণিক তন্তুশিল্পী হিসাবে ‘তকাজে ব্যাপৃত থাকলেও পড়া-লেখালেখির নিমিত্তে অসংখ্য শব্দরাশি নিয়ে নিত্যদিনের কাটাকুটি। লেখেন মূলত শিল্পকলা বিষয়ে, তবে সংখ্যায় বেজায় কম চিন্তায় কোনাে গুরুনির্দেশ বা বিধিবিধান খাটে না। সঠিক মাত্রায় বাঁধবার আয়াসে বরং বােধ ও প্রাণের ফজিলত শিল্পায়তে নাজিল হয়। প্রকাশিত পুস্তকাদি ‘শিল্পমনীষা’ (২০০১), ‘তদ্ভুকলা ও ট্যাপেস্ট্রি’ (২০০৪), ‘পরনকথা নগরদাইর’, ‘ভিঞ্চি নােটস্’, ‘শিল্পদর্শন’ (২০১০), তন্তুবায় স্বরূপ সন্ধান (২০১৪), ‘মানুষ ভজে রং তুলিতে, ‘শিল্পবয়ান' (২০১৯)। ফসলের আদিম শরীর থেকে বুনাে আমােদে গন্ধ-ছডানাে আরণ্যক গ্রাম বুকে নিয়ে পথিবীর নানা শহরে-গঞ্জে পিঠ ঠেকিয়েছেন বিবিধ ওসিলায়। গত দেড়দশক ধরে শিল্পী শফিকুল কবীর চন্দন ইউরােপ-অভিবাসী। দীর্ঘ একটা সময় কেটেছে উত্তর-ইতালির মিলান শহরে। সার্বক্ষণিক তন্তুশিল্পী হিসাবে বর্তমানে ইংল্যান্ডের লাফবরা শহরে স্ত্রী ও দুই পুত্রসন্তান নিয়ে বসবাস। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের বয়ন ঐতিহ্যের প্রাণভূমি নরসিংদী জেলার এক ছােট সবুজ গ্রামে একদা জন্ম ও বেড়ে ওঠা ছেলেটি আজ পাশ্চাত্যে তাঁতে পােড়েনের রঙে, নকশায়, বুননে হাজির করে স্মৃতি ছবির মগ্নতা।