ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার কালে মানুষ নিজ নিজ পরিচিত বৃত্তে বন্দি। তারপরও জলের মতাে ঘুরে ঘুরে মানুষ ঠিকই কথা বলে। নিস্তরঙ্গ ও আটপৌরে বাস্তবতার ভাঁজে ভাঁজে লুকানাে থাকে গল্প, গল্প পরম্পরায় মূত হয় সময়ের ধ্বনি।
এইসব কলহাস্য উপন্যাসে স্তরে স্তরে মানুষ ভিড় করে; যারা নানা টানাপােড়েনের মধ্যেও জীবনকে দু’হাতে ধরে তুমুল বেঁচে থাকতে চায়। এখানে ভিড় করে অনিশ্চয়তা; আসে ব্যক্তিগত লাভালাভ বা স্বার্থচিন্তা- ঘন হয় প্রতিকূলতা; আর এসবের মধ্যে অন্তরপ্রবাহের মতাে ছড়িয়ে থাকে বেঁচে থাকবার আশ্চর্য স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গ, অন্তহীন বেদনা ও প্রভূত আনন্দ।
বহমান বাতাসের মতাে মানুষ আসে অবিরাম মানুষের পাশে। আবেগ-উৎকণ্ঠা-রাগ-অনুরাগের কত না বিনিদ্র সিড়ি তারা তৈরি করে!
এইসব কলহাস্য-র নায়ক তাই ‘এই সময়’;-এই সময়ের ছুটে চলা মানুষ; জীবন ও জীবিকার অন্বেষণে যাদের অধিকাংশের দাঁড়াবার সময় নাই। এদেরই একজন তরুণ সজল-যার আটপৌরে দৈনন্দিনতায় প্রীতি ও করুণা হয়ে আসে তৃষা। তৃষার বিড়ম্বিত বাস্তবতা-অসুস্থ সন্তান ও স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব তার ইচ্ছেগুলােকে নিজের মতাে করে ডানা মেলতে দেয় না। সজল-তৃষা মুখােমুখি হয়ে জানতে পারে, শরীর আর মনের অজস্র অনুভূতি তাদের অনুভবের বাইরেই থেকে যায়।
নিজের ইচ্ছেয় জীবন গড়তে গিয়ে এমন এক সিদ্ধান্ত নেয় আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মিতা-সেই সিদ্ধান্ত চিরদিনের মতাে তার প্রেমিক-স্বামী রাশেদ মনসুরের সাথে তার বিচ্ছেদই কেবল ঘটায় না; রাশেদকে দেশ থেকে অনেক দূরে ছিটকে ফেলে। ভৌগােলিক দূরত্ব মানসিক তৃষ্ণা-বিতৃষ্ণাকে শেষ করতে পারে না অবশ্য; আরও পারে না পরস্পরের প্রতিশােধ নেবার আদিম স্পৃহাকে নষ্ট করতে! মানুষের পাশে মানুষ, মানুষের মুখােমুখি মানুষ-চেনা পরিপার্শ্বের অভিনব উপস্থাপনায় এই উপন্যাস হয়ে ওঠে সমকালীন বিপন্ন জীবন ও আত্ম-আবিষ্কারের অনুপম দলিল-এর মাঝে বাষ্পরুদ্ধ নিঃশব্দতা যেমন থাকে, থাকে ফুসফুসভরা হাসি। শেষ পর্যন্ত চির অপরিবর্তনীয় চাঁদের মতাে মানুষের জীবন। আসলে সবকিছুর পরও বেঁচে থাকবার আকুলতার আরেক চিহ্ন- যাকে আমরা ‘কলহাস্যময়’ বলে এই উপন্যাসে শনাক্ত করি।