অনেকে বলতে চান, জাদুবাস্তবতার রচনাভঙ্গি গ্রহণ করে স্বতন্ত্রভাবে লেখক হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার মানসেই তিনি লেখক-নাম শহীদুল হক থেকে শহীদুল জহিরে বদল করেছিলেন। উত্তর-আধুনিক প্রগতিবাদী লেখক হিসেবেও শহীদুল জহিরকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। শহীদুল জহির তাঁর রচিত সাহিত্যে ভাষা ব্যবহারে অভিনবত্ব আনার চেষ্টা করেছেন, হয়তো সফলও হয়েছেন। সাধারণভাবে বলা যায়, তিনি নিম্নবর্গের মানুষের মুখের অকৃত্রিম ভাষাকে পুঁজি হিসেবে নিয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যজগতের ব্যতিক্রমী স্রষ্টা শহীদুল জহির অকালপ্রয়াত। বিগত শতাব্দীর সত্তরের দশকে সৃজনশীল সাহিত্য অঙ্গনে তাঁর আগমন ঘটেছিল। সে সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন। তাঁর সাহিত্য-সৃষ্টি আমৃত্যু (২০০৮) বহমান ছিল। তাঁর সৃষ্টির পরিমাণগত দিক খুব বেশি না হলেও গুণগত দিক অসাধারণ। অসাধারণত্বের বিষয়টি নানা দিক থেকে মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ঘটনার বহুরৈখিক বর্ণনা, বুননশৈলী, শেকড়স্পর্শী অনুসন্ধান, প্রতিটি বিষয় সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে উপলব্ধিপূর্বক তা সুসংগঠিত করা, পূর্ণাঙ্গতা—এ সবই তাঁর সৃষ্টিকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, সংরক্ষণ এবং সংগ্রহের অভাবে অনেক সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম কালের অতল গহবরে তলিয়ে যায়। এ বিষয়টি অনুধাবন করে শহীদুল জহির স্মৃতি পরিষদ ও পাঠক সমাবেশ যৌথভাবে শহীদুল জহির সমগ্র প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত শহীদুল জহির সমগ্রটি অপ্রত্যাশিত পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে এবং সংস্করণটি দ্রুতই নিঃশেষ হয়ে যায়। ইতিমধ্যে শহীদুল জহিরের বেশ কিছু অগ্রন্থিত অপ্রকাশিত গল্প, উপন্যাস ও অন্যান্য লেখার সন্ধান পাওয়া যায়। পরে প্রাপ্ত এই লেখাগুলি একটি অখণ্ড ‘সমগ্র’র মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করলে অতিরিক্ত ভারী হয়ে যায়। তাছাড়া, সকল পাঠক উপন্যাস ও গল্প—দুটি বিষয় একত্রে সংগ্রহ করতে না-ও চাইতে পারেন। এই বিবেচনায় পাঠকের পছন্দ, ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে কেনার সুবিধার্থে নতুন সংযোজনসহ শহীদুল জহির রচনা সমগ্র তিনটি পৃথক খণ্ডে, যথা—শহীদুল জহির উপন্যাস সমগ্র, শহীদুল জহির গল্প সমগ্র এবং অপ্রকাশিত অগ্রন্থিত শহীদুল জহির প্রকাশ করা হলো।
Shahidul Zahir (১৯৫৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর) পুরান ঢাকার নারিন্দার ৩৬ ভূতের গলিতে (ভজ হরি সাহা স্ট্রিট) জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তার নাম ছিল মোহাম্মদ শহীদুল হক। তার পিতা এ কে নুরুল হক ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা ও মা ছিলেন গৃহিনী। তার পৈতৃক বাড়ি ছিল সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার হাশিল গ্রামে। তার দাদা জহিরউদ্দিন (সম্ভবত তিনি তার জহির নামটি তার দাদার কাছ থেকে নিয়েছিলেন) ছিলেন স্কুলশিক্ষক ও তার দাদী জিন্নাতুন নেসা। তার পিতার শৈশবেই তারা মারা যান। তার নানা ছিলেন সিরাজগঞ্জের আমলাপাড়ার আজিমুদ্দিন আহমেদ ও নানি হামিদা বেগম, যাদের কাছে তিনি প্রায়ই বেড়াতে যেতেন। এই জায়গাগুলি এবং সাতক্ষীরার ফুলবাড়ীয়া যেখানে তিনি প্রায়ই বেড়াতেন, তার মনে গভীর ছাপ রেখে যায় এবং পরবর্তীতে তার সাহিত্যকর্মে এই জায়গাগুলির উল্লেখ পাওয়া যায়। শহীদুল জহির তার স্কুলজীবন শুরু করেছিলেন ঢাকার ৩৬ রাঙ্কিন স্ট্রিটের সিলভারডেল কেজি স্কুলে, পরবর্তীতে ঢাকা, ফুলবাড়ীয়া, ময়মনসিংহ, সাতকানিয়া ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্কুলে পড়েছেন। সাতকানিয়া মডেল হাই স্কুল থেকে এস.এস.সি পাশ করেন ও ঢাকা কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাশ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ওয়াশিংটন ডিসির আমেরিকান ইউনিভার্সিটি ও বারমিংহাম ইউনিভার্সিটিতেও পড়ালেখা করেন। তিনি ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে সহকারী সচিব পদে যোগ দেন। ২০০৮ এ তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সচিব পদে কাজ করে গেছেন। শহীদুল জহির ছিলেন চিরকুমার এবং প্রায়ই তাকে এব্যাপারে প্রশ্ন শুনতে হত। কথা ম্যাগাজিনের সম্পাদক কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে তিনি এটি ব্যাখ্যা করতে অক্ষম , "আমি এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারব না, এটা এমনিতেই ঘটে গেছে" তার চার ভাই ও চার বোন ছিল। তার বাবা ১৯৯০ এ মারা যান ও তার মা ঢাকায় ভাইবোনদের সাথে থাকেন। তিনি কম কথা বলতেন এবং অন্তর্মুখী ছিলেন। তার সাথে বন্ধুত্ব করা কঠিন ছিল তবে তিনি অনেক বন্ধুসুলভ ছিলেন। তিনি ২০০৮ সালের ২৩ মার্চ ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হসপিটালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়।