কুন্তীর বস্ত্রহরণ কিছু বাস্তুহারা মানুষের মর্মন্তুদ কাহিনি। '৪৭-এর দেশভাগ, '৭১-এর। স্বাধীনতা—এই উপন্যাসের ভিন্ন দুটো চরিত্র। যে উদ্দেশ্যে দেশভাগ বা একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ, কিছু লােভী মানুষের কারণে সেই উদ্দেশ্যটাই নস্যাৎ হয়েছে বারবার। ভূমিদখল—এই উপন্যাসের প্রধান ঘটনা। কিন্তু কিছু মানুষ ভূমিলােভীদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কমলেন্দু রায়চৌধুরী, বিপিন গুহ, অজয় পাল, কুন্তী-ওই রুখে দেওয়াদের কেউ কেউ। তাদের বাধার কারণে ইয়াছিন মােল্লা কি রামচন্দ্রপুরের জমিদারবাড়িটি দখলে নিতে পারে? এককালের ছাত্র জব্বার শিক্ষক বিপিন গুহের বসতভিটেটা কি আত্মসাৎ করতে পারে? চেয়ারম্যান আবুল কাশেমের সামনে। মূর্তিমান বাধা হয়ে দাঁড়ায় কুমােরপাড়ার কুন্তী। কুন্তীকে ডিঙিয়ে একাত্তরের রাজাকার আবুল কাশেম কি কুমােরদের শ্মশানটি জবরদখল করতে পারে? শেষ পর্যন্ত কুন্তীর কী পরিণতি হয়? এই উপন্যাসের নাম। কুন্তীর বস্ত্রহরণ কেন? এই সকল প্রশ্নের উত্তর আছে এই উপন্যাসে। সকল কিছুকে ছাপিয়ে উপন্যাসটি শেষ অবধি। কুমােরদের সমাজালেখ্য হয়ে উঠেছে। হরিশংকর জলদাসের উপন্যাসের প্রধান মূলধন বিষয়বৈচিত্র্য। কুন্তীর বস্ত্রহরণ তার উদাহরণ। বরাবরের মতাে এই উপন্যাসেও হরিশংকরের ভাষা সরল, মনােগ্রাহী এবং ইঙ্গিতময়।
প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হরিশংকর জলদাস ১৯৫৫ সালের ১২ই অক্টোবর বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের উত্তর পতেঙ্গা গ্রামের এক জেলে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা যুধিষ্ঠির জলদাস পেশায় ছিলেন একজন জেলে। ফলে আর্থিক অভাব অনটন আর অর্থনৈতিক টানাপোড়েনই ছিল হরিশংকরের বেড়ে ওঠার সঙ্গী। হরিশংকর জলদাসের শৈশব-কৈশোর কাটে পতেঙ্গার কৈবর্তপাড়ায়। তার বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে জেলের জীবনযুদ্ধে না জড়িয়ে শিক্ষিত করবেন যেন ছেলে সম্মানের জীবনযাপন করতে পারে। হরিশংকরের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় দেবেন্দ্রলাল দে’র আদাবস্যার নামের এক পাঠশালায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে তিনি ভর্তি হন পতেঙ্গা বোর্ড প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৭১ সালে পতেঙ্গা হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে বাবার স্বপ্ন পূরণে আরো একধাপ এগিয়ে যান হরিশংকর। 'জাইল্যা' ঘরের সন্তান বলে তাকে বিভিন্ন সময়ে অপমানিত হতে হয়েছে, শুনতে হয়েছে ‘জাওলার ছাওয়াল’ কটুক্তি। সেই কথার উচিত জবাব দিতে তিনি ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ‘নদীভিত্তিক বাংলা উপন্যাস ও কৈবর্ত জনজীবন’ বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এখানে তিনি জেলেদের জীবনের সকল আনন্দ-বেদনা, উৎপত্তি-বিকাশ, তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন ইত্যাদি তুলে ধরেন। পেশাগত জীবনে হরিশংকর জলদাস চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান। কিন্তু কর্মজীবনের শুরুতে অভাবের দিনগুলোতে তিনি দিনে শিক্ষকতা এবং রাতে বাবার সাথে সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতেন। ৪৭ বছর বয়সে তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘জলপুত্র’ লেখেন। এরপর, ক্রমাগত বাজারে আসতে থাকে হরিশংকর জলদাসের নতুন বই। হরিশংকর জলদাসের বইগুলোতে সবসময়ই উঠে এসেছে নিপীড়িত, প্রান্তিক এবং নিচুতলার মানুষের কথা। হরিশংকর জলদাসের উপন্যাসসমগ্র সমৃদ্ধ হয়েছে ‘আমি মৃণালিনী নই’, ‘হৃদয়নদী, ‘রামগোলাম’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ইত্যাদি চমৎকার উপন্যাসের মাধ্যমে। হরিশংকর জলদাসের ছোটগল্প ‘লুচ্চা’, ‘জলদাসীর গল্প’, ‘মাকাল লতা’ প্রভৃতিও পাঠকপ্রিয়। এছাড়া দুটি আত্মজীবনী রচনা করেছেন তিনি। ‘কসবি’, ‘দহনকাল’, ‘জলপুত্র’ হরিশংকর জলদাস এর সেরা বই। মধ্যবয়সে লেখা শুরু করলেও সাহিত্যকর্মে নতুন মাত্রা যোগ করায় তিনি বহু পুরস্কার অর্জন করেছেন। ২০১১ সালে ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা পুরস্কার’ (দহনকাল), ২০১৩ সালে ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’ (জলপুত্র), ‘ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার’ (প্রতিদ্বন্দ্বী), ‘বাংলা অ্যাকাডেমি পুরষ্কার’, ‘সিটি আনন্দ আলো পুরস্কার’ সহ ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৯ সালে তিনি পেয়েছেন ‘একুশে পদক’।