বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ গৌরব তার মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের এই মুক্তিযুদ্ধে জাতির অংশগ্রহণ ছিল সর্বাত্মক। বাঙালির বিস্ফোরণ ছিল তার জাতিত্ব সনাক্তকরণের সময় থেকে দীর্ঘ দিনের রাজনীতিক পরাধীনতা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধাগ্রস্ততা ও সংস্কৃতি বিকাশে প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠার। চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। এটা ঠিক যে, খ্রিষ্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দি থেকে ভাষাকে কেন্দ্র করেই বাঙালির জাতিত্বের সূচনা। তখনকার শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শিল্প-সংস্কৃতির বাহন ছিল সংস্কৃত। লােক-জীবনের ভাষা ছিল অবধারিত ভাবেই উপেক্ষিত। সমাজে যাদেরকে অন্ত্যজ-অস্পৃশ্য বলা হত, তাদেরই পরিচর্যায় বেড়ে উঠতে থাকে। লােকজ ভাষা বাংলা ভাষা। প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষার এই চর্চাকে শ্রেণিবিভক্ত সমাজেরই উচ্চস্তরের মানুষদের শিল্প-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবেই গণ্য করা যেতে পারে। তুর্কি বিজয়ের (১২০২খ্রি.?) পর একটা সময়ে বাংলাভাষা রাজ পৃষ্ঠপােষকতা পেয়েছিল বটে। অন্য দিকে রাজনীতিক ক্ষমতাচ্যুতির কারণে বর্ণবাদী সমাজের উচ্চ শ্রেণির হিন্দুদের অস্তিত্ব রক্ষার একটা সমস্যাও দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তদুপরি সামাজিক নিগ্রহ থেকে মুক্তি পাবার বাসনা সূচনা করেছিল ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়াও। সুতরাং তাদের দিক থেকেও প্রয়ােজন পড়েছিল তাদেরই সৃষ্ট নিম্নবর্ণের মানুষদের সাথে ইন্টারেকশনের। ফলতঃ তখনকার হিন্দু সমাজের লৌকিক দেবদেবীর প্রতিষ্ঠা যেমন ঘটতে থাকে, তেমনই বাংলা ভাষায়ও শুরু হয় তাদের মাহাত্ম কীর্তন। এটাও বােধহয় সম্ভব হয়েছিল-প্রথমতঃ সংস্কৃত লােকমুখের ভাষা না হওয়া, দ্বিতীয়তঃ তার দুরূহতা। পাশাপাশি ধর্মীয় বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও মুসলমানেরাও সাহিত্য-সঙ্গীত সৃষ্টির বাহন হিসেবে মাতৃভাষা বাংলাকেই গ্রহণ করতে শুরু করে। সুতরাং জনগােষ্ঠীতে ধর্মীয় বিভাজন ঘটলেও বাংলা ভাষাকে আশ্রয় করে ঘটতে থাকে বাঙালি জাতির বিকাশ। ঘটনা-দুর্ঘটনা, স্রোত-অন্তস্রোত নানা কিছু, রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক নানা ভাবে দেখা গেলেও বৃটিশ আমল পর্যন্ত এ রকমটিই ছিল গড় চিত্র। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে গঠিত পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গে জাতিত্বের প্রশ্নে নতুন সমীকরণ শুরু হয়। অবাঙালি জাতিগত এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অবমূল্যায়ন ও সেই সাথে পুঁজি বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা বাঙালি মুসলমানের চিন্তা-চেতনার এক গুণগত মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা করে।