মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি-কথা’ ত্রিশটি প্রবন্ধের একটি সংকলন গ্রন্থ। এটি প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর দুই বছর পর ১৯৫৮ সালে। সংকলিত প্রথম প্রবন্ধের শিরোনামেই গ্রন্থের নামকরণ। তাই বলা যায় সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিচর্চার নানা বিষয়আশয় এই গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য। গ্রন্থে সংকলিত প্রবন্ধসমূহ ‘অহমিকা-সৌন্দর্য চেতনা- রবীন্দ্রনাথ’, ‘ব্যর্থতা জিন্দাবাদ’, ‘মূল্যবোধ ও যুক্তিবিচার’, ‘রেনেসাঁস : গোড়ার কথা ও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি’, ‘মেরুদণ্ড’, ‘ব্যক্তি ও রাষ্ট্র’, ‘সাহিত্য সম্বন্ধে নানা কথা’, ‘নবযুগ’, ‘আমাদের দৈন্য’, ‘মনুষ্যত্ব’, ‘জীবন ও বৃক্ষ’, ‘স্বাধীনতা : জাতীয়তা : সাম্প্রদায়িকতা’, ‘একটি নিবেদন’, ‘সম্মান ও আত্মসম্মান’, ‘একখানি চিঠি’, ‘কাজী নজরুল ইসলাম’, ‘লাইব্রেরি’, ‘বাঙ্গালা ভাষায় মুসলমানী শব্দ’, ‘নজরুল ইসলাম ও রেনেসাঁস’, ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘রবীন্দ্রনাথের শিশু-কবিতা’, ‘শিক্ষা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও বৈরাগ্য-বিলাস’, ‘দুঃখবাদ’, ‘বাংলাকাব্যে দুঃখবাদ’, ‘আদেশপন্থী ও অনুপ্রেরণাপন্থী’, ‘মধ্যশিক্ষা ও অর্থকরীবিদ্যা’, ‘প্রাথমিক বাংলা গদ্য ও তার স্রষ্টাগণ’ এবং ‘বর্ষ-পঞ্জী’। সংকলিত প্রবন্ধসমূহের বিষয়বৈচিত্র্য গ্রন্থের গভীরতা ও মননশীলতার পরিচায়ক। গ্রন্থের গদ্যরীতি লেখকের স্বকীয় মহিমায় ভাস্বর। এর রচনার বিষয়-আঙ্গিক তথা মননে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এবং রচনাশৈলীতে প্রমথ চৌধুরীর প্রভাব সুস্পষ্ট। গ্রন্থে সংকলিত প্রবন্ধমালা পাঠে সংস্কৃতি, ধর্ম, মূল্যবোধ ও মানবতাবোধের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে সহজেই। মানুষের জীবনাচরণের মৌলিক বিষয়াদি সংজ্ঞায়িত ও উন্মোচিত হয়েছে এই গ্রন্থের পাতায় পাতায়। ‘সংস্কৃতি-কথা’ পাঠে তাই মানব প্রগতি তথা মানবমুক্তির পথ-সন্ধানী পাঠকমাত্রই লেখকের সঙ্গে উচ্চারণ করতে পারেন ‘মনুষ্যত্ব জিন্দাবাদ’।
মােতাহের হােসেন চৌধুরী (১৯০৩-১৯৫৬) জীবদ্দশায় পরিচিত মণ্ডলে এবং সাধারণ পাঠকদের মধ্যে বিশেষ শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। সমাজ ও রাষ্ট্রের যদি নূন্যতম আনুকূল্য পেতেন তা হলে জীবৎকালেই তাঁর দু’চারটি বই প্রকাশিত হতাে। অতীব দুঃখের বিষয় মৃত্যুকালে তার কোনাে প্রকাশিত গ্রন্থ ছিল না। সাহিত্যজীবনের নানা পর্যায়ে মােতাহের হােসেন চৌধুরী একাধিক নামে পত্রপত্রিকায় লিখেছেন, যেমন- মােতাহের হােসেন বি. এ, সৈয়দ মােতাহের হােসেন চৌধুরী বি.এ, মােতাহের হােসেন চৌধুরী এম. এ, মােতাহের হােসেন। চৌধুরী প্রভৃতি। শেষ জীবনে শুধু মােতাহের হােসেন চৌধুরীই লিখতেন। চাকরি-বাকরিসংক্রান্ত ও ব্যক্তিগত কোনাে প্রয়ােজনে তিনি তাঁর পিতৃদত্ত নাম সৈয়দ মােতাহের হােসেন চৌধুরী লিখতেন। তার পৈত্রিক বাড়ি নােয়াখালী জেলার রামগঞ্জ থানার কাঞ্চনপুর গ্রামে। পিতা সৈয়দ আবদুল মজিদ চৌধুরী ছিলেন একজন সাব-রেজিস্ট্রার। খ্রিস্টীয়-ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে এটি ছিল সম্মানজনক চাকরি । তাদের পারিবারিক সূত্র থেকে জানা যায়, ফিরােজ শাহের রাজত্বকালে শাহ সৈয়দ আহমদ তনুরী ওরফে শাহ মিরান নামে একজন সুফি সাধক ইরাক থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এই উপমহাদেশে আসেন। মােতাহের হােসেনের মাতামহ মৌলবী আশরাফ উদ্দিন আহমদের বাসভবন ছিল কুমিল্লা শহরের ‘দারােগা-বাড়ি'। এই দারােগা-বাড়িতেই মােতাহের হােসেনের জন্ম। তাঁর নিজের হাতে লেখা পুরনাে কাগজপত্র দেখে প্রবন্ধ-সমগ্রের সম্পাদক সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রমাণ পেয়েছেন তাঁর জন্মতারিখ : ১ এপ্রিল ১৯০৩।