বৈশিক অবক্ষয় দুর্যোগ মহামারির মহাক্রান্তিলগ্নে অদম্য অভিলাষী মানুষ যখন গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ডানা মেলার স্বপ্নে বিভোর, ঠিক তখন মানিকের কবিতা হয়ে ওঠে মানবিক বোধিসত্তার আমিয় প্রস্রবণ। আধুনিক সভ্যতার আগ্রাসনে সনাতনী গ্রামীণ ভূগোলের পরিসর ছোট হয়ে আসা সন্ধিক্ষণে তার মনচৈতন্যে জেগে ওঠা অতি নাগরিক পটভূমির বহুরৈখিক স্তরে এ কবিতাগুলো সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর মতো বেদনামধুর। আর তার ‘বেদন ভ্রূণ’ জন্ম নেয় বাঁধভাঙা চাঁদের হাঁসি থেকে নয়; বরং চাঁদমারি বনে অঢেল জোছনার প্লাবনের মাঝেই তার বেদনার জন্মভিটা। এই বেদনা একান্ত তার নিজস্ব মনোভূমে বেড়ে ওঠা এক আত্মজ বৃক্ষ। এর যেমন আছে গোপন যাতনা তেমনি আছে সৃষ্টিশীলতার দায়ও। আর এই দায়ভার আছে বলেই বেলাজ লুটেরাদের লুণ্ঠন দেখতে দেখতে গুপ্ত থেকেও তার নিস্তার মেলে না। তারা তাকে ছাইস্বর্ণ ভেবে উত্তপ্ত কড়াইয়ে ছেঁকে জারণ করে নেয়। অবহেলিত-নিপীড়িত-বিত্তবৈভবহীন অসহায় মানুষের পাশে যেমন মানুষ থাকে না, তেমনি থাকে না ঈশ্বরও। এই উপলব্ধি মানিকের আত্মদর্শনে ‘মানুষ ও ঈশ্বরের সমান্তরাল স্বভাব’ হিসেবে অভিযোজিত হতে দেখা যায়। নিখাদ প্রগতিশীল সমাজমনস্কতা, স্বদেশ ও বৈশ্বিক রাজনীতির উত্থান-পতন, ইতিহাস-ঐতিহ্যচেতনা, প্রেম-দ্রোহ, অপূর্ণ-অতৃপ্ত আত্মজীবনের পাষাণদীর্ণ হাহাকার এ কাব্যে অনন্য মাত্রায় অভিযোজিত হয়েছে। স্বোপার্জিত অভিজ্ঞতা, স্বতন্ত্র মনোভঙ্গি ও বক্তব্য প্রকাশের বলিষ্ঠতা এ কাব্যটিকে একটি বিশেষ মর্যাদার আসনে অভিষিক্ত করেছে বলে মান্য। এখানে মানব মনের আশা-নিরাশার দোলাচলে কাল থেকে কালান্তরে উড়ে যাওয়া ভাব-বিহঙ্গকে দেখি নিমেষে মানুষ ও বস্তুভূমির কঠিন সত্যে মুখোমুখি হতে। এই সত্য প্রকাশের অঙ্গীকার ও একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে সাধারণ পাঠকের অন্তরাত্মায় উম্মীলন ঘটাবে একটি তৃতীয় চোখ। আবেগ নামক ছুটন্ত বল্মাঘোড়ার নিপুণ দক্ষতার লাগাম নিয়ন্ত্রণের কৌশলী প্রয়োগ কাব্যটিকে একটি সমৃদ্ধ ভাব-ঐশ্বর্যের ভিত্তিভূমি দান করেছে। স্রেফ অধ্যাত্মবাদী সম্মোহিত সাধুর মতো ফানাফিল্লাহ মার্গে নিবিষ্ট নন মানিক; বরং জাগতিক জীবনের বহুবিধ সমস্যা মোকাবিলা করে ধ্যানী সারসের মতো আত্মমগ্ন ও স্বীয় লক্ষ্যে স্থির। এ কাব্য সেই স্থিরকৃত গন্তব্যের চূড়ান্ত রূপায়ণ। আলম তৌহিদ
জন্ম: ২৮ জানুয়ারী ১৯৭১ অনেক কম বয়স থেকেই মানিক বৈরাগী খেলাঘরের সাথে যুক্ত হয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। অষ্টম শ্রেণির ছাত্র অবস্থাতেই তার প্রথম ছড়া প্রকাশিত হয়। এভাবে যুগপৎ লেখালেখি ও রাজনীতিতে তিনি তুমুলভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। এ সময় এরশাদ বিরোধী স্বৈরাচার আন্দোলন তীব্র হলে তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি প্রকাশ করতে থাকেন ভাঁজপত্র-'মুক্তির উল্লাস' ও ছড়াপত্রিকা 'শ্রম'। পনের আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু বার্ষিকীতে 'পিতা' নামে শোক স্মারকও তিনি প্রকাশ করেন। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত। ইউনিয়নের ভাঙনের রেশ ধরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট রাজনীতিতে প্রভাব ফেলে। হতাশাগ্রস্থ অন্য অনেক ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীর মতো তিনিও যোগদান করেন ছাত্রলীগে। এ সময়েই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে ছাত্র শিবিরের ক্যাডাররা প্রতিহিংসাবশত তার পা কেটে দিলে লেখাপড়ার সমাপ্তি ঘটে সেখানেই। এরপর শুধু রাজনীতি আর রাজনীতি। ছেদ পড়ে তার লেখালেখিতে। দায়িত্ব নেন চকরিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতির। ২০০১-০৬ সনের জোট সরকারের শাসনামলে তার উপর নেমে আসে ভয়াবহ নির্যাতন। ফেরারী হন তিনি। আবার কারাবন্দিও হন। এ সময় তাকে বাবা মা'র জানাজায়ও অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয়নি। কারামুক্তির পর তাকে রিসিভ করেন তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা। ঘটনাবহুল এমন রাজনৈতিক জীবনের পর তিনি আবার লিপ্ত হন তার নিজস্ব কবিতা ভুবনে। সে সবের প্রয়াস হিসেবে ২০১১ সালে বের হয়েছিল তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ 'গহীনে দ্রোহ নীল'। 'শুভ্রতার কলঙ্ক মুখস্থ করেছি' তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ।