ভাষা বিজ্ঞানের সূত্র সম্মত বাংলাদেশে বেদে সমাজ নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি আছে, বিদ্বেষও আছে। তারা প্রান্তবাসী, তাদের দশ হাত দূরে রাখতে শুধু ভদ্ৰশ্রেণি নয়, পল্লিসমাজও পছন্দ করে। তাদের পরিযায়ী জীবনযাত্রা সুস্থির, গৃহকেন্দ্রিক জনগােষ্ঠীর নিশ্চয়তা প্রত্যাশার সঙ্গে বিরােধে যায়, সে জন্য তাদের নিয়ে একটা অস্বস্তিও জনমনে আছে। সাপের। খেলা দেখানাে অথবা লােকচিকিৎসা দেয়া এবং এ রকম কিছু গৌণ কাজের মধ্যেই মােটামুটি তাদের কর্মপরিধি সীমাবদ্ধ। অথচ তাদের বসবাস কৌম সমাজে, নারীদের অবস্থান সেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত, তাদের নৈতিক-নান্দনিক বােধ, সৃষ্টিশীলতার চর্চা এবং একটি ভাষা আছে, যা ঠার বা ঠেট বলে পরিচিত। বেদেদের জীবনের ভেতরে খােলামন নিয়ে। উঁকি দিলে একটি ছবি দেখা যাবে। যদিও খুব কম মানুষই সেই চেষ্টা করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে এই কাজটি দরদ নিয়ে, নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন হাবিবুর রহমান। তিনি দীর্ঘদিন থেকে এই জনগােষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশা মােচন ও তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনের মূলধারায় নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করে আসছেন। বস্তুগত সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি হাবিবুর রহমান। বেদেদের ভাষা নিয়ে গবেষণা করে ঠার বেদে জনগােষ্ঠীর ভাষা নামে একটি বই লিখেছেন। ঠার ভাষার সঙ্গে আরাকানি মনতং নৃ-গােষ্ঠীর ভাষার অনেক মিল, তবে মিলটা বাংলা ভাষার, বিশেষ করে এর আদিরূপ প্রাকৃতের সঙ্গে বেশি। হাবিবুর রহমান ভাষাবিজ্ঞানের সূত্রগুলাে মেনেই লিখেছেন বইটি, যার ফলে তাঁর গবেষণার একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও তৈরি হয়েছে। ঠার ভাষার বহুল প্রচার হােক, যাতে বেদেদের সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীতে ইতিবাচক কিছু পরিবর্তন আসে।
হাবিবুর রহমান ১৯৬৭ সালের ১ জানুয়ারি গোপালগঞ্জ জেলার চন্দ্রদিঘলিয়া গ্রামের আব্দুল আলী মোল্লা এবং মোসাম্মৎ রাবেয়া বেগম দম্পতির ঘরে ভোরের প্রদীপ্ত সূর্য হয়ে জন্মগ্রহণ করেন হাবিবুর রহমান । শৈশব থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় নিবেদিত এক প্রাণ তিনি ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা 3 গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে কৃতিত্বের সাথে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে তিনি ১৭তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন । চাকুরি-জীবনে যে কর্মস্থলেই দায়িত্ব পালন করেছেন, সেখানেই রেখে এসেছেন তাঁর সৃষ্টিশীল চিন্তা-চেতনা আর ব্যতিক্রমী কর্মস্পৃহার স্বাক্ষর । পেশাগত জীবনে তাঁর অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য যেমন লাভ করেছেন প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি, তেমনই অর্জন করেছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও। হাবিবুর রহমান তিনবার বাংলাদেশ পুলিশ পদকে (বিপিএম) এবং দুবার প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদকে (পিপিএম) ভূষিত হন। এছাড়া তিনি তিনবার ‘আইজিপি গুড সার্ভিস ব্যাজ' লাভ করেন। বর্তমানে তিনি অ্যাডিশনাল ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ পদমর্যাদায় বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বহুমুখী প্রতিভা ও অসাধারণ মানবিক গুণাবলির অধিকারী হাবিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন বিশেষ করে বাংলাদেশ পুলিশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা ও সংকলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং তা সংরক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। সম্পাদনা করেছেন মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা, পিতা তুমি বাংলাদেশ এবং ঠার: বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা গ্রন্থসমূহ। বাংলাদেশের বেদে এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও সমাজের মূলধারায় তাদের প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তিনি পথিকৃৎ। তাঁর অতল মানবিক গুণের ফসল পুলিশ ব্লাড ব্যাংক, যা করোনা রোগীদের প্লাজমা এবং ডেঙ্গু রোগীদের প্লাটিলেট সরবরাহ করে কোভিড-১৯ ও ডেঙ্গু চিকিৎসায় প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে।