বাঙ্গালা গবেষণা বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ৩ এর অন্তর্ভুক্ত গ্রন্থত্রয় হচ্ছে Politics and Society in East Pakistan and Bangladesh (ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ঊনিশ শতকের বাঙালী সমাজ (জুন, ১৯৭৪) এবং যুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশ (মার্চ, ১৯৭৫)। Politics and Society in East Pakistan and Bangladesh গ্রন্থে ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি ও ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুই পর্বে এবং যুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশ গ্রন্থে ১৯৭২ সালের আগস্ট থেকে ১৯৭৪ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত সময়কালের রাজনৈতিক ভাষ্য উপস্থাপিত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে বলা যায় এ সকল রচনাতে সে সময়ের ‘...class analysis, the character of ruling and exploiting classes of Bangladesh, their various policies...’ (উমর ১৯৭৪ ক) বিষয়ে যেমন আলোচিত হয়েছে তেমনি শাসক-শোষক শ্রেণীর অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ-আন্দোলনের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। যুদ্ধপূর্ব বাঙলাদেশ পর্বে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে তৎকালীন ভূ-রাজনৈতিক, ধারণাগত, নীতিকৌশলগত, শ্রেণীগত ও জাতিসত্তাগত অবস্থা, মৌলিক গণতন্ত্র, ছাত্র রাজনীতি, ঘেরাও, বয়কট, ১১ দফা, এলএফও, আসাদ হত্যা, ভাসানী ও ন্যাপের ভূমিকা ইত্যাদিসহ আইউব-ইয়াহিয়া সামরিক শাসনামলের বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়েছে। এইসব রাজনৈতিক ঘটনাবলীর নিবিড় পর্যবেক্ষক হওয়ার কারণে এবং প্রতিরোধে সরাসরি অংশগ্রহণের কারণে কী হচ্ছে এবং কী হতে যাচ্ছে সে বিষয় স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন উমর, যা তাঁর ভাষ্যগুলিতে প্রকাশ পেয়েছে। অন্যদিকে বাঙলাদেশ আমলে নতুন দেশে পুরানো শত্রু, নিক্সন-ম্যাকনামারা-কেনেডীর ভূমিকা, আওয়ামী লীগের জাতীয়করণ ও সমাজতন্ত্রের কর্মসূচী, রুশ বিদায় মার্কিন প্রবেশ, সমাজতন্ত্র-গণতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতা-জাতীয়তাবাদ সহ নবগঠিত সংবিধান, সিপিবি ও মোজাফফর ন্যাপের ভূমিকা, ভাসানী ন্যাপের ভূমিকা, সরকারের স্বৈরতন্ত্র, মুদ্রাযন্ত্র ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স, সংখ্যালঘু জাতিসত্তার অবস্থান ইত্যাদি বহুতর রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাতে ‘যুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশের একটি সাধারণ ও সামগ্রিক চিত্র’ (উমর ১৯৭৫ ক) পাওয়া যাবে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ঊনিশ শতকের বাঙালী সমাজ গ্রন্থের দুটি বিশেষ দিক রয়েছে কীভাবে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব বিবেচনা করা প্রয়োজন তা গ্রহণযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গীতে আলোচনা করা। এবং ১৯৭০ সালে পশ্চিম বাঙলা থেকে প্রকাশিত দেশব্রতী পত্রিকার মাধ্যমে সরোজ দত্ত ও চারু মজুমদার কর্তৃক সূচিত সাংস্কৃতিক কর্মসূচীর মাধ্যমে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রমুখের মূর্তি ভাঙার বিভ্রান্তকারী, নৈরাজ্যবাদী, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে বাঙলাদেশে বাহিত হতে না দেয়ার জন্য একটি প্যারাডাইম উপস্থাপন করা। সে সময়ের সাপ্তাহিক গণশক্তি পত্রিকা সম্পাদনাকালে এই পত্রিকাটিকে সে ‘সাংস্কৃতিক’ আন্দোলনের মুখপত্র হতে দেননি তাঁরা। বস্তুত, বদরুদ্দীন উমর সম্পাদিত গণশক্তি পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতিমালা অনুসরণের মাধ্যমে বাঙলাদেশে চারু মজুমদারদের ঔ ভ্রান্ত লাইন প্রতিরুদ্ধ হয়েছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ঊনিশ শতকের বাঙালী সমাজ গ্রন্থটিতে একদিকে ঈশ্বরচন্দ্রের শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতা আলোচিত হয়েছে; অন্যদিকে শিক্ষা, পরিবার ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান আলোচিত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের সাথে বিদ্যাসাগরের চিন্তার এবং ভূমিকার বৈসাদৃশ্যও প্রসঙ্গক্রমে আলোকপাত করা হয়েছে। এইসব আলোচনার মাধ্যমে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি দিক এই গ্রন্থে অনুসন্ধান করা হয়েছে। এ বিষয়ে উমর লিখেছেন, ‘ঊনিশ শতকের সামাজিক কাঠামো থেকে উদ্ভূত নানান সামাজিক চিন্তা ও সংস্কার আন্দোলন এবং জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আন্দোলন ও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন কিভাবে মধ্যশ্রেণীর চিন্তাকে গঠন ও নিয়ন্ত্রণ করে পরিশেষে কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে নিজের প্রভাবকে ছড়িয়ে দিয়েছিলো সেই প্রক্রিয়াটিকেও বোঝার চেষ্টা করা। অর্থাৎ ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলন ও বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঐতিহাসিক মূল কোথায় নিহিত তার অনুসন্ধান করা।’ (উমর ১৯৭৪ খ)। এ বিষয়ে পর্যালোচনা করা এবং অবহিত হওয়া দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্য অপরিহার্য। কাজেই, এ গ্রন্থটির বিভিন্নমুখী প্রাসঙ্গিকতা স্পষ্ট আকারে অদ্যাবধি বলবৎ রয়েছে।
বদরুদ্দীন উমরের জন্ম ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর পশ্চিম বাঙলার বর্ধমান শহরে। মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, রাজনীতিবিদ, প্রাবন্ধিক ও ইতিহাসবিদ হিসেবে তিনি বাঙলাদেশে সুপরিচিত। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. পাশ করার আগেই ১৯৫৪ সালে দর্শন বিভাগে অস্থায়ীভাবে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে এম. এ. পাশ করার পর ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজে এবং ১৯৫৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি এই তিন বিষয়ে অনার্স ডিগ্ৰী অর্জন করেন। ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগেরও তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা। ষাটের দশকে প্রকাশিত তাঁর তিনটি বই সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৬), সংস্কৃতির সংকট (১৯৬৭) ও সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৯) তত্ত্বকালে বাঙালী জাতীয়তাবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সময় পাকিস্তান সরকারের সাথে তাঁর বিরোধ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবং তিনি নিজেই ১৯৬৮ সালে অধ্যাপনার কাজে ইস্তফা দিয়ে সরাসরি রাজনীতি ও সার্বক্ষণিক লেখালেখিতে নিজেকে নিয়োজিত করেন।