জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে দেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত বাঙালি জাতি ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ জাদুমন্ত্র বুকে নিয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধে বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা কে কার আগে পুণ্যময় শাহাদাত বরণ করবে, ’৭১-এ সেই পুণ্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল লক্ষ-কোটি বাঙালি ভাই বোন। নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ বীর সন্তান আর চার লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৬ই ডিসেম্বরে বাঙালি জাতির বিজয় অর্জিত হয়। ’৭১ সালে ৩০ লাখ বাঙালি ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে যাঁর পুণ্য নামে হাসিমুখে জীবন উৎসর্গ করেছেÑ মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ’৭৫-এর ১৫ই আগস্ট তাঁদের সেই পুণ্যময়- জ্যোতির্ময় মুক্তিদূত বঙ্গবন্ধুকে পাকসেনাদের ঔরসজাত এ দেশেরই কিছু জারজ সন্তান সপরিবারে হত্যা করে! দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে নির্মম এ হত্যাযজ্ঞের আকস্মিকতায় বাঙালি জাতি বেদনাদীর্ণ বক্ষে গভীর-গহীন শোক মাতমে কাতর, পাথর হয়ে পড়ে! নেতারা আতঙ্কে অন্ধকারে হারিয়ে গেলেও প্রজাতন্ত্রের রণাঙ্গন ফেরত বীর তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা ‘৭১ এর ন্যায় আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে। খুনিদের বীরদর্পে রুখে দাঁড়ায়। বাঙ্গালির ঘরে ঘরে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিরোধের অগ্নিপিন্ড। এই বই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের প্রতিরোধে বাঙালি বীরদের বিক্রমের ও আত্মদানের বীরত্ব গাঁথা। বইটির লেখক অবসরপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মদ মুসা (লেখক নাম: মুসা সাদিক) ১৯৭২ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত (জেনারেল জিয়ার ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত সময় ব্যতীত) ১৪ বছরে বঙ্গভবনে ৬ জন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গভবনে খুনিদের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। রক্ত পিপাসু সেই খুনিদের প্রতিরোধে বঙ্গভবনে ও সচিবালয়ের সদ্য রণাঙ্গন ফেরৎ এক থোকা টগবগে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপণ প্রতিরোধের ও আত্মদানের অমর কাব্য এ গ্রন্থ। প্রজাতন্ত্রের জনসেবকদের ও বাঙালি জাতির নব প্রজন্মের সংগ্রামের ও শহীদী মৃত্যু বরণের অমর অনুপ্রেরণার অনন্ত উৎস এ বই।
মুসা সাদিক মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ওয়ার করেসপনডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘রণাঙ্গন ঘুরে এলাম’ এবং ‘মুক্তাঞ্চল ঘুরে এলাম’ শিরোনামে প্রচারিত দুটি কথিকা তিনি স্বকণ্ঠে প্রচার করতেন। কথিকা দুটি সপ্তাহে কয়েকবার প্রচার হতো। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান ও গতিবিধির ওপর তাঁর সরবরাহকৃত গোয়েন্দা তথ্য মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর রণ-কৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর দুঃসাহসিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ লিখেছেন ‘... মুক্তিযুদ্ধে সামরিক ও বেসামরিক ক্ষেত্রে জনাব মুসার অপরিসীম অবদান এবং বীর যোদ্ধা ক্যাপ্টেন হুদা যেভাবে পাকসেনাদের গোলাবৃষ্টির মধ্যে নিজের জীবনের নিরাপত্তা উপেক্ষা করে মুসার জীবন বাঁচিয়েছেন, সে জন্য তাঁদের উভয় জনের নাম ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করার জন্য এবং তাঁদের কাছে জাতির ঋণ স্বীকার করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সরকারের পক্ষে আমি এখানে স্বাক্ষর করলাম।’ স্বাক্ষর : তাজউদ্দীন আহমদ, তারিখ : ২১.০৩.১৯৭২। তাজউদ্দীন আহমদ-প্রদত্ত এই স্বীকৃতির পর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তিনি ‘জীবন্ত শহিদ’ হিসেবে খ্যাত হয়ে ওঠেন। যৌবনের শুরুতে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা মুক্তিযোদ্ধা লেখক মুসা সাদিক বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ে ভিন্ন-ভিন্ন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ১২ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। অবসরের পূর্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সচিব পদে নিয়োজিত ছিলেন। সাহিত্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র মুসা সাদিকের প্রকৃত নাম মোহাম্মদ মুসা। তিনি ১৯৫১ সালের ৩০শে অক্টোবর সাতক্ষীরা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। অবসরোত্তর জীবনে লেখালেখি ছাড়াও সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত আছেন।