বিজনে নিজের সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় . এই প্রথম এয়ারপোর্টে আমাকে কেউ পৌঁছে দিতে আসেনি। যদিও এবারেই আমি যাচ্ছি সবচেয়ে বেশি দূরে। প্রথমবার যখন বিদেশে যাই, তখন সমস্ত এয়ারপোর্ট প্রায় ছেয়ে গিয়েছিল আমার বন্ধুবান্ধবে। সে কতকাল আগেকার কথা। তখন বিদেশ যাত্রা এখনকার মতন এমন জল-ভাত ছিল না। আর বাংলা কবিতা লিখে বিদেশে আমন্ত্রণ পাওয়া শুধু অভাবনীয় নয়, অবিশ্বাস্য মনে হত। সেই প্রথমবার মনে হয়েছিল, আকস্মিক ভাবে এই যে সুযোগ পেয়েছি, এই তো যথেষ্ট, আর কখনও যাওয়া হবে না, এবারেই প্রথম ও শেষ। আমার সেই যাবার মূলেও ছিল প্রবল ইচ্ছাশক্তি। গরিবের ছেলে হলেও দৃঢ় সংকল্প ছিল, যে-কোনও উপায়ে বিশ্ব-ভ্রমণে যাবই যাব! কোনও যোগ্যতা না থাকলেও জাহাজের খালাসির চাকরি নেব, রান্নাঘরের পাচকের তৃতীয় সহকারী হয়ে আলুর খোসা ছাড়াব, তবু তো দেখা যাবে অকূল সমুদ্রের রূপ, জাহাজ থামবে অচেনা বন্দরে বন্দরে। কত ভ্রমণকাহিনীতে এরকম বিবরণ পড়ে উদ্দীপিত হয়েছি। বাঙালিদের মধ্যে বিশ্ব-পর্যটক হিসেবে এক সময় খুব খ্যাতিমান হয়েছিলেন রামনাথ বিশ্বাস, তিনি ছিলেন আমার ছোটবেলার হিরো, ইস্কুল-বয়েসে সেই জলজ্যান্ত মানুষটিকে একবার দেখতে গিয়েছিলাম। . আমাদের ছোট নদী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় . ফরাসি দেশে লোয়ার নামে একটি নদী আছে। খুব একটা বড় নদী নয়, আমাদের দেশের বিখ্যাত নদ-নদীগুলির তুলনায় ছেলেমানুষ। এই লোয়ার নদীর খ্যাতি অন্য কারণে, এ নদীর দুই তীরে রয়েছে অনেকগুলি সাতো বা দুর্গ সমন্বিত প্রাসাদ। যেগুলির স্থাপত্য শিল্প নৈপুণ্য অতুলনীয়। সারা পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ ওই লোয়ার উপত্যকার সাতোগুলি দর্শন করতে যায়। প্রত্যেকটি সাতোর অন্দরে রয়েছে ইতিহাসের বহু রোমাঞ্চকর কাহিনী, অনেক ছবি ও ভাস্কর্য, একটি বিশেষ সাতোর সঙ্গে অমর ইতালিয়ান শিল্পী লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চির নাম যুক্ত হয়ে আছে।
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।