ভূমিকা কাজী নজরুল ইসলাম দোটানায় পড়েছিলেন -ফুল নেবেন না অশ্রু নেবেন। তাঁর গানের বাণীতে তিনি সুললিত ভাষায় এই দোটানার আর্তি প্রকাশ করেছেন। আমিও দোটনায় পড়েছি। বাংলাদেশের সুরস্রষ্টাদের কথা লিখবো, না লেখক সাঈদ আহমেদের কথা লিখবো। দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। লেখক সাঈদ আহমদ বাংলাদেশের একগুচ্ছ সঙ্গীতসাধকদের সমাবেশ ঘটিয়েছেন তাঁর লেখা ‘বাংলাদেশের সুরস্রষ্টারা’ গ্রন্থে। সঙ্গীতসাধকদের জীবন অবলম্বনে রচিত বই বাংলাদেশের সাহিত্য ভুবনের নেই বললেই চলে। ফলে আমাদের দেশের বরেণ্য সঙ্গীতসাধকরা বর্তমান প্রজন্মের কাছে ,বলতে গেলে, অচেনা। অথচ দেশের সংস্কৃতি ও কৃষ্টির লালন ,বিকাশ ও প্রসারে তাঁদের যে অবদান তার কথা নতুন প্রজন্মের কাছে অজ্ঞাত অজানা থাকলে দেশের জন্য শুভকর হতে পারে না। এই উপলব্ধি থেকেই লেখক ও শিল্পী সাঈদ আহমদ বরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞদের কৃতিত্ব ও অবদানের কথা লিখেছেন সহজ সরল ভাষায় পরিসরে। সাঈদ আহমদ লেখক তো বটেই , একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পীও। শিল্পী সাঈদ আহমদ সেতারে তালিম নিয়েছেন, রাগরাগিনীর গূঢ় তত্ত্বের সন্ধান করেছেন। ব্যবহারিক তালিমের সঙ্গে তত্ত্বীয় জ্ঞান আহরণ করে নিজের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার ফলে দুই ধারার কথাই তিনি প্রতিটি জীবনী লেখার সময় প্রকাশ করেছেন অভিজ্ঞ সঙ্গীতজ্ঞের মতো। শিল্পী সাঈদ এমন পরিবারের সন্তান যে পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশেল সংস্কৃতির সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। তিনি একজন বাগ্মী। সাহিত্য সংস্কৃতি-নাটকের কথা অনর্গল বলতে পারেন। জ্ঞানের পরিধি এতো বিস্তৃত যে অনায়াসে যেন ইতিহাসের দুয়ার খুলে যা্য় তাঁর কথা বলা শুরু হতে না হতেই। তাঁর সম্পর্কে আরো অনেক কথা বলতে পারি। এমনকি ,সুরস্রষ্টাদের সারিতে তাঁর নামও আমি নিজের লেখা দিয়ে সংযোজন করে দিতে পারি। সেটা হয়তো তিনি চাইবেন না। রাজিও হবেন না। বোধগম্য কারণেই। লেখক তার ‘বাংলাদেশের সুরস্রষ্টারা ‘ গ্রন্থে একুশজন সঙ্গীতসাধকের জীবনী সংযোজন করেছেন। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে প্রকাশিত হচ্ছে গ্রন্থটি। একুশ আর একুশের যেন মিলন ঘটেছে না তাঁর গ্রন্থে। এই মিলন ঘটালেন সাহিত্য প্রকাশের মফিদুল হক। প্রত্যাশা রইলো, তাঁর এ ধরণের উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। ‘বাংলাদেশের সুরস্রষ্টারা ‘ গ্রন্থ প্রকাশের ভেতর দিয়ে লেখক সাঈদ আহমদ আরি প্রকাশক মফিদুল হক নতুন এক দিগন্তের দুয়া্র উন্মোচন করলেন। তাঁদের যুগল প্রয়াস সঙ্গীত ভুবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। পাঠকমহলেও তাঁদের যুগল-কীর্তি নিশ্চিতরূপে অভিনন্দিত হবে এই কামনা। মোবারক হোসেন খান পশ্চিম রামপুরা ,ঢাকা।
সাঈদ আহমদ, জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৩১, ঢাকা। পড়াশােনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস্-এ। পুরনাে ঢাকার সম্ভান্ত পরিবারের সন্তান, বড় হয়েছেন গানবাজনা, নাটক-চলচ্চিত্র ঘেরা পরিমণ্ডলে । বাল্যে সেতারবাদন শিক্ষা নিয়েছেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের কাছে, পরে খাদেম হােসেন খানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পঞ্চাশের দশকের গােড়ায় তৎকালীন ঢাকা বেতারে অর্কেস্ট্রা বাদন পরিচালনা করেছেন। সঙ্গীতজগতের গুণী ব্যক্তিত্বদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছেন তিনি। নাটক ও চিত্রকলার প্রতি তার আগ্রহ গভীর। কালবেলা (১৯৬২), মাইলপােস্ট (১৯৬৫), তৃষ্ণায় (১৯৬৮), একদিন প্রতিদিন (১৯৭৪) এবং শেষ নবাব (১৯৮২) তার উল্লেখযােগ্য নাটক। ষাটের দশকে রচিত ও অভিনীত তার বিভিন্ন নাটক আধুনিকতার ধারণা বয়ে আনে। বাংলা নাট্যমঞ্চে ইংরেজিতেও কয়েকটি নাটক লিখেছেন তিনি। এছাড়া তাঁর নাটক অনূদিত হয়েছে ফরাসি, জার্মান, ইতালীয়, উর্দু ও পাঞ্জাবি ভাষায়। তিনি চিত্রকলার সমালােচক হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। নাট্যকার, চিত্র-সমালােচক ও সংস্কৃতিবেত্তা হিসেবে বিশ্বের নানা দেশ পরিভ্রমণ করেছেন, অর্জন করেছেন বিভিন্ন সম্মান ও পুরস্কার। বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৭৫ সালে, ওয়াশিংটনের এরিনা স্টেজের নাট্যশালার দর্শকাসনের একটি সারিতে তাঁর নামাঙ্কিত রয়েছে, ফরাসি সরকারের লিজন দ্য অনার পেয়েছেন ১৯৯৩ সালে। সাঈদ আহমদের পরিপূর্ণ শৈল্পিক সত্তা ও বহুমুখী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড তাঁকে সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছে।