ডেল কার্নেগি প্রসঙ্গ-কথা আমাদের সুখ-দুঃখ আশা-নিরাশায় পূর্ণ জীবনের বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত হয় কর্মের চিন্তায়। আসুন, এই কর্মজীবনকে সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিময় করে তোলার চেষ্টা করি। হয়তো আপনি ব্যস্ত কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে, যার সাথে মিলে আছে আরো অনেক লোকের স্বার্থ, তখন আপনার মুহূর্তের ভুল আপনাকে এবং সেইসব মানুষদের। সকলকেই ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যতিব্যস্ত করে তুলবেই। ফলে সারাদিন অজস্র পরিশ্রম করেও দিনের শেষে অত্যন্ত ক্লান্ত, শ্রান্ত, বিমর্ষ হয়ে পড়বেন। এই হতাশার হঠাৎ আঘাতে আপনার কাছে জীবন হয়ে উঠবে হয়তো দুর্ভাবনার। কর্মজীবন হয়ে উঠবে বৈচিত্রহীন, আনন্দহীন। তখন একটু অবসরের জন্যে মনটা আপনার তৃষ্ণার্ত হয়ে। উঠবে। নিঃসন্দেহের মনের বিজ্ঞানী ডেল কার্নেগির এই রচনা আপনাকে ওই হতাশ, অন্ধকার জীবনে আলোর সন্ধান দেবে! কারণ এই মানুষটির এই অমূল্য রচনা পাঠ করে পৃথিবীর সব প্রান্তের কোটি কোটি মানুষ পেয়েছে জীবনের আকাঙ্ক্ষিত সফলতা। ডেল কার্নেগির এই বইটি তার কল্পনপ্রসূত অন্তঃসার শূন্য উপদেশ নয়। এটি তার আয়াসলব্ধ অভিজ্ঞতার ফসল। এটি তার সংগ্রামী চেতনালব্ধ জীবনদর্শন। মনে করুন, আমরা আজ থেকেই সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে, ডেল কার্নেগির প্রদর্শিত পথে চলতে শুরু করি। পাকা ডুবুরীর মতো বিস্তীর্ণ এই সংসার সমুদ্রের অতল থেকে যিনি তুলে এনেছেন অসংখ্য অভিজ্ঞতার রত্নসম্ভার, তার সেই অমূল্য সঞ্চয় মুদ্রিত এ গ্রন্থে। এ বই আপনাকে দেবে হাজার আনন্দের রোশনাই। এমন বন্ধু, এমন স্বজনের সান্নিধ্য আপনি লাভ করতে পারবেন, যা পাখির কূজনের মতো মধুর, সূর্যের রশ্মির মতো দৃপ্ত, চাঁদের আলোর মতো স্নিগ্ধ। আপনি পেয়ে যাবেন সফল কর্মজীবনের চাবিকাঠি, জনচিত্ত জয় করবার জাদুকাঠি। কুসুমের মতো কোমল ও বজ্রের মতো কঠিন ব্যক্তিত্ব। কর্মময় জীবনকে নিত্য নতুনভাবে সাজিয়ে নেয়ার সফলতা ছড়ানো আছে আপনার চারপাশে, শুধু চাই সঠিক ও নিষ্ঠ পরিশীলন। যা ডেল কার্নেগি শিখিয়েছেন, চিনিয়েছেন, আপনাকে-আমাকে-সকলকে। আপনার কর্মজীবন সমৃদ্ধ হোক। সুখের ছোঁয়া লাগুক আপনার জীবনে এটুকুই আমার আন্তরিক কামনা। এসব বই আপনি কেন পড়বেন? এসব বই আপনাকে কীভাবে উপকার করবে? নিজেকে খুঁজুন। মনে রাখবেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় আপনার কাছে আপনার নিজের সত্তা। অনুসরণ নয়। অনুকরণ নয়। নিজেকে জানুন, সফলতার উপায় অর্জন করুন। নিজের পথে চলুন। সুন্দর, নিটোল, ছিমছাম কাজের চারটে উপায় আছে। তাহল : প্রথমত, কাজের টেবিল সবসময় পরিষ্কার রাখুন। অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরিয়ে ফেলুন। দ্বিতীয়ত, গুরুত্ব অনুযায়ী পরপর সাজিয়ে নিয়ে কাজ করুন। তৃতীয়ত, সমস্যা যখনি আসবে তখনি তার সমাধানে সচেষ্ট হোন, তবে তড়িঘড়ি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন। চতুর্থত, ক্লান্ত বা অবসন্ন করে এমন কোনো বিশৃঙখল কাজ করবেন না। সফল ও সুন্দর কাজের জন্যে সবচেয়ে জরুরি সংগঠন, শৃঙ্খলী আর নিয়ন্ত্রণ। ক্লান্তি, বিষণ্ণতা, হতাশা আর দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হবার সহজ কিছু পন্থা আছে, তাহল : প্রথমত, সঠিক সঙ্গী নির্বাচন। জানেন তো, প্রিয়তমা তরুণীর সাথে দশ মাইল হেঁটে গেলেও আপনি ক্লান্ত হবেন না, কিন্তু একান্ত আপনজন হলেও বিরক্তিকর স্ত্রীর সঙ্গে দশ পা হাঁটতেও আপনার কষ্ট হবে। এর কারণ খুঁজে বের করা ও সমাধান করা। দ্বিতীয়ত, এই আত্মবিশ্বাস সর্বদা জাগরূক রাখা যে, আপনার যা আছে তার দাম লক্ষ টাকারও বেশি। তৃতীয়ত, সস্তা ও অকারণ সমালোচনার প্রশয় দেবেন না। কারণ তা আপনার ব্যক্তিসত্তাকে ছোট করবে। অতি প্রশংসা আপনার ব্যক্তিত্বকে খর্ব করবে। আপনি হতাশ হবেন। চতুর্থত, কখনোই কাজে ফাঁকি দেবেন না। নিষ্ঠা ও আত্মরক্ষার ক্ষমতাই আপনাকে নিশ্চিন্ত করবে। ছদ্ম। প্রশংসায় আপ্লুত হলে, আপনি কাজ করবেন কেমন করে। পঞ্চমত, আপনার চারপাশে ছড়িয়ে আছে অজস্র সুযোগ। তাকে হেলায় হারাবেন না। মধু আহরণে আপনি যদি ব্যর্থ হোন তার জন্যে মৌচাককে দায়ী করতে পারেন না। মধু আহরণের সহজ পন্থা কি, খুঁজে নেয়া। আশাবাদী হওয়া। ষষ্ঠত, জনসংযোগের কয়েকটি সহজ রাস্তা ডেল কার্নেগি দেখিয়েছেন এ বইতে, যা আপনাকে প্রফুল্ল রাখবে। সপ্তমত, কর্মই জীবন, এ কথা মনে রাখবেন। যে কর্মঠ সে বিশ্ব জয় করতে পারে। অলস কর্মহীন মানুষকে সবাই বর্জন করে। একাকী নির্জন পথে তাকে চলতে হয় বিষণ্ণ ও হতাশ হয়ে। স্বজনশূন্য মানুষ অসহায়। জীবনে খুশি ও সহায়তায় আশ্বাস দেয় প্রিয়জন, স্বজন। সেই স্বজনের বন্ধুত্ব লাভ করার কয়েকটি সরল পথ ডেল কার্নেগি দেখিয়েছেন এই পর্যায়ে। জনচিত্ত জয় করার গুরুত্বপূর্ণ গুণটি কীভাবে আয়ত্ত করা যায় তার মূল্যবান চাবিকাঠি কেমন করে পাওয়া যাবে সে পথ দেখিয়েছেন ডেল কার্নেগি।
ডেল ব্রাকেনরিডজ কার্নেগী, এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে ২৪ নভেম্বর, ১৮৮৮ সালে জন্ম নেওয়া এই আমেরিকান লেখক তাঁর আত্ম-উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও বইয়ের পাতায় আজও বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এক নাম। সেলফ-ইম্প্রুভমেন্ট, সেলসম্যানশিপ, করপোরেট ট্রেনিং, পাবলিক স্পিকিং, ও ইন্টার পার্সোনাল স্কিল এর মতো দারুণ সব প্রশিক্ষণের উদ্ভাবন ও এসব বিষয়ে লেখা ডেল কার্নেগী এর বই সমূহ আশার আলো দেখিয়েছে অসংখ্য হতাশাচ্ছন্ন মানুষকে। মিসৌরিতে দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়ার দরূণ বালক বয়স থেকেই কাজ করেছেন ক্ষেতখামারে। এর মাঝেও ওয়ারেন্সবার্গের সেন্ট্রাল মিশৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন। কলেজ শেষে জীবিকার তাগিদে বেকন, সাবান এবং লার্ড (শূকরের চর্বি মিশ্রিত করা) তৈরির কাজও করতে হয় আর্মর অ্যান্ড কোম্পানির জন্য। ফার্মের প্রধান হিসেবে অনেক সাফল্য লাভ ও ৫০০ ইউএস ডলার সঞ্চয়ের পর ১৯১১ সালে বহুদিনের লালিত স্বপ্ন অধ্যাপক হওয়ার জন্য বিক্রয় সেবার কাজটি ত্যাগ করেন তিনি। কিছু ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা ঝুলিতে নিয়ে যখন ওয়াইএমসিএ- এর ১২৫ নম্বরে বাস করতে শুরু করেন, তখনই পাবলিক স্পিকিং এর ধারণাটি মাথায় খেলা করে কার্নেগীর। সেই সময় মোট লভ্যাংশের ৮০% শতাংশের বিনিময়ে ওয়াইএমসিএ এর পরিচালকের কাছে শিক্ষা প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এভাবেই ১৯১২ সাল থেকে কার্নেগী কোর্সের যাত্রা শুরু হয়। পুরো আমেরিকাবাসীর কাছে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির পথ হয়ে উঠে তার পদ্ধতি। ডেল কার্নেগী এর বই সমগ্র এর মধ্যে ‘হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স’ বইটিকে তার সেরা অবদান হিসেবে ধরা হয়। প্রথম প্রকাশের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই যার ১৭তম মুদ্রণও প্রকাশ করতে হয়েছিলো। ডেল কার্নেগী এর লেখাগুলো বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। ‘বিক্রয় ও জনসংযোগ প্রতিনিধি হবেন কীভাবে’, ‘বন্ধুত্ব ও সম্পদ লাভের কৌশল’, ‘বড় যদি হতে চাও’, ‘ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও সাফল্যের সহজ পথ’ এমন নানা নামের অনূদিত ডেল কার্নেগী বাংলা বই অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে বাংলাভাষী পাঠকদেরও। ডেল কার্নেগী শ্রেষ্ঠ রচনাসমগ্র এর মধ্যে আরও আছে ‘দ্য বায়োগ্রাফি অব আব্রাহাম লিংকন’, ‘ফাইভ মিনিট বায়োগ্রাফিস’ এবং ‘বিশ্বায়নের পটভূমি’। ১ নভেম্বর, ১৯৫৫ সালে আমেরিকান এই অধ্যাপক মৃত্যুবরণ করেন।