বাংলার লোকসাহিত্য নির্ভেজাল বাঙালি সংস্কৃতির ধারক। মানুষের চিন্তা চেতনা এবং দেশজ আবহের প্রতিনিধি। লোকসাহিত্য এবং লোকসংস্কৃতি আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের, জাতীয় সংস্কৃতির মূল বুনিয়াদ রচনা করেছে। লোকসাহিত্যের সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা এখনো আবিষ্কার না হলেও লোকদের দ্বারা লোকদের জন্য সৃষ্ট সাহিত্যকে সাধারণত লোকসহিত্য মনে করা হয়। লোকসাহিত্য বরিশালের অনন্য সম্পদ। ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ, লোকগীতি, পুঁথি, লোককাহিনি, লোকনাটক, বরিশালের বৃত্ত অতিক্রম করে বাংলা সাহিত্যকে সম্পদশালী করেছে। হাজার বছর ধরে লোকের মুখে মুখে সৃষ্টি হওয়া এইসব অমূল্য সম্পদ কিছুটা গ্রহণ ও বর্জনের ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ, পুঁথি, কাহিনি একজন রচয়িতার সৃষ্ট নয় বলে অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত রচয়িতার সন্ধান পাওয়া সম্ভব হয়নি। লোকসাহিত্য লিখিত অলিখিত দুরকমই হতে পারে। জনগণের মুখে মুখে রচিত সাহিত্যই পরে প্রয়োজনের তাগিদে লিখিত হয়ে থাকে। লিখিত রূপ মূলের থেকে কিছুটা পৃথক হলেও ভাব ও বিষয়বস্তুর তেমন পরিবর্তন হয় না। লোকসাহিত্যের দরজা থাকে সব সময়ই উন্মুক্ত। আর তাই নিত্য নতুন উপকরণ ও ভাবে তা হয়ে ওঠে বিচিত্র ও সুষমামণ্ডিত। জনজীবনের কাজ, খাওয়া, পড়া, সৌন্দর্য বোধ, আচার-আচরণ, দুঃখবোধ ও অকারণ খুশির দোলা এর পরতে পরতে বিস্তৃত। এখানে কৃত্রিমতার স্থান নেই। কারণ যা কিছু বাইরের, তাকে নিজের মতো করে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রকাশ করাই এর ধর্ম। লোকসাহিত্যের বিষয়গুলো হচ্ছেÑ ১. ছড়া ২. গান ক) পালা-পার্বন উপলক্ষে মেয়েদের গান। (বিয়ের গান, ব্রতের গান) খ) উৎসব উপলক্ষে পুরুষের নৃত্য সম্বলিত গান। (ঘাটু, জারী-সারী) গ) ব্যবসায়ীর গান। (বেদের গান, পটুয়ার গান) ৩. গীতিকা ৪. কথা কাহিনী উপকথা ৫. ধাঁধা ইত্যাদি। (বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-৪র্থ খণ্ড, কাজী দীন মুহম্মদ) লোকসাহিত্য অঞ্চল ভেদে তার আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে ব্যঞ্জনাবহ হয়ে ওঠে। আর এই আঞ্চলিকতার কারণে এর মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে সেই অঞ্চলের জীবনাচরণের নানা বৈশিষ্ট্য। এরই নিরিখে খুঁজে পাওয়া যায় অঞ্চলগুলোর অতীত ঐতিহ্য। বরিশালের লোকসাহিত্য ও লোকগীতি সে দিক থেকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। লোকসাহিত্যের স্রষ্টারা সাধারণত সরলমনা। তাঁরা প্রাচীন সংস্কার ও প্রথার প্রতি অনুরক্ত থাকে। লোকসাহিত্য তাই অকৃত্রিম। তাদের বিশ^াস, চিন্তাধারা, আনন্দ-বেদনা, জীবন সংগ্রাম তাদেরই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশে দীপ্তময় হয়ে ওঠে। বরিশালের লোকসাহিত্য সম্পর্কে লেখার আগে বরিশালের পরিচয় দেয়া আবশ্যক। বরিশালের প্রাচীন নাম বাকলা বা চন্দ্রদ্বীপ। বাকলা বলেশ^র ও মেঘনা নদীর মধ্যভাগে অবস্থিত। এ জনপদ অতি প্রাচীন এবং পুরাতত্ত্বের আকর। বাকলা রাজ্য দক্ষিণ বঙ্গে অবস্থিত ও পৌরানিকদেশ। শাস্ত্রগ্রন্থে এর নাম ও সীমা উল্লেখ আছে। ‘দিগি¦জয় প্রকাশ বৃত্তি’ গ্রন্থে বাকলা চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের যে সীমা নির্দেশ করা হয়েছে তা নিম্নরূপ: মেঘনানদী পূর্ব ভাগে পশ্চিমেচ বলেশ^রী। ইন্দিলপুরী যক্ষ সীমা দক্ষিণে সুন্দরং বনং ॥ ত্রিংশং যোজন বিমিতো সোম কান্তাদ্রি বর্জিতঃ। সোম কান্তেচ দ্রৌ দে শৌ বিখ্যাতো নৃপশেখর ॥ জম্বুদ্বীপঃ পশ্চিমেচ স্ত্রীকারোহী তথোত্তরে। বাকলাখ্য মধ্যভাগে রাজধানী সমীপতঃ ॥ পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে বলেশ^র, উত্তরে ইদিলপুর, দক্ষিণে সুন্দরবন এ ভূ-ভাগ ত্রিশ যোজন পরিমাণ পর্বতহীন সোমকান্ত দেশ, মধ্যভাগে বাকলা নামক রাজধানী। মুসলিম শাসনামলে বাকলা চন্দ্রদ্বীপ বলে পরিচিতি লাভ করা এই বরিশাল অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দের কারণে ভাব, ভাষা ও সাহিত্য, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। যা এখন অতীত স্মৃতির সুতোমাত্র। আলেকজান্ডারের ‘গঙ্গারিডি’ প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপ বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। ডঃ ওয়াইজ ও ওয়াটারস এর মতে ‘গঙ্গারিডির’ রাজধানী ছিল কোটালীপাড়ায়। ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত কোটালীপাড়া বরিশালের অধীন ছিল। চন্দ্রদ্বীপ ছিল ‘গঙ্গারিডি’ রাজ্যের মূল ভূখণ্ডে। ডায়োডোরাসের মতে, ‘ভারতের সকল জাতির মধ্যে গঙ্গারিডিরাই শ্রেষ্ঠ’। বর্তমান বরিশাল বিভাগ, বাগেরহাটের কচুয়া, মোড়লগঞ্জ, ফরিদপুরের কোটালীপাড়া, টুঙ্গীপাড়া, কালকিনি, মাদারীপুর ও ঘোষের হাট চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ব্লকম্যানের মতানুযায়ী বাকলা চন্দ্রদ্বীপ ১৪৮৭ সাল পর্যন্ত স্বাধীন ছিল। চন্দ্রদ্বীপের রাজা কর্ন্দপনারায়ণ রায় ১৫৭৬-১৬১১ সাল পর্যন্ত স্বাধীন ভাবে চন্দ্রদ্বীপ শাসন করেন। বরিশাল অঞ্চলের অধিবাসীরা এক ঐতিহ্যপূর্ণ মানবগোষ্ঠীর বংশধর। ‘বরিশালের ইতিহাস’ এর লেখক সিরাজউদ্দীন আহমেদের মতে, ‘বাঙালি জাতির আদি বাসস্থান ছিল চন্দ্রদ্বীপে’। হেনরী বেভারিজ এর মতে, ‘বাকেরগঞ্জের অধিবাসী বাঙালি চরিত্রের খাঁটি নিদর্শন’। ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদারসহ আরও অনেকের মতে, ‘দক্ষিণ বঙ্গের বাঙ্গালা থেকেই আজকের বাংলার নামকরণ।’