অর্পা এর আগে নৌকায় চড়েনি কিন্তু প্রথমবার উঠেও তেমন কোনো ভয় পেল না। প্লাস্টিকের নৌকা,বসার সুন্দর ব্যবস্থা করা। পাশেই কাঠের নৌকা ছিল কিন্তু কেন যে তন্ময় তা না নিয়ে এগুলোতে উঠল তা বুঝল না। এই নৌকা নিজে প্যাডেল ঘুরিয়েই চালানো যায়। যদিও একটা বৈঠা রাখা আছে এখানে তবুও তন্ময় ওটা না ধরেই প্যাডল চালিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। - এটাকে ঠিক নৌকা বলে মনে হচ্ছে না। - কিন্তু প্রথমই তোমাকে নিয়ে রিস্কে যেতে সাহস পেলাম না। কাঠের নৌকায় ছিদ্র থাকে। অনবরত পানি উঠতে থাকে। একজন থাকে শুধু পানি সেঁচার কাজে। ওই অবস্থায় তুমি আনন্দের চেয়ে ভয়টাই পেতে বেশি । - আপনি এত অল্প সময়ে এত কিছু ভেবে আবার সিদ্ধান্তও নিলেন? বাব্বাহ! - জীবনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বড় জরুরি, কোনো একটা ভুল সিদ্ধান্তকে কিন্তু তোমার জীবন মোটেও মেনে নিবে না। শাস্তি দিবেই দিবে। - আপনি প্রায় সময় অনেক কঠিন কথা বলেন, আমি বুঝি না। কেমন জানি তখন ডিজি ডিজি লাগে। - তুমি মুখে না বললেও তা তোমার চোখেমুখে আমি ঠিকই দেখি। - আজবতো! - সবই আজব। এই আমি, কোনোদিন কোনো মেয়েকে নৌকায় চড়াবো তা ভাবিনি অথচ আজ তোমাকে নিয়ে এলাম। আজব না? পুরোটাই আজব। - প্লিজ আর এত কঠিন কথা বলবেন না। সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। - আমার সাথে এই মাঝ নদীতে বসে তোমার ভয় লাগছে না? - উঁহু। - মিথ্যে বলছো? - উঁহু। - তোমরা কেন আমাদেরকে এতটা বিশ্বাস কর? - আম্মু বলেন বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর। বিশ্বাস ছাড়া না কি জীবন অচল। - অথচ আমার আম্মুকে দেখো সে কিন্তু এই অচল জীবন টেনে নিয়ে যাচ্ছে তা প্রায় বিশ বছর হল। - মানে? বুঝলাম না। - আরে মেয়ে এসব পরে বুঝলেও চলবে, এখন এদিকটায় এসো। প্যাডেলটা শিখো, বেশ মজা পাবে। অর্পা আর কথা বাড়ালো না, নিজের সীটটা ছেড়ে এগিয়ে প্যাডেলটার পাশে বসল। তন্ময় ওকে দেখিয়ে দিল কীভাবে পা দিয়ে ঘুরাতে হয়। অর্পা কিছু সময়ের জন্য ওইদিকে মনযোগ দিল। এলোমেলো ভাবে বোটটা ঘুরতে লাগল মাঝ নদীতে। চারপাশে এমন অনেকগুলো বোট ঘুরছে দেখতে বেশ ভালোই লাগছিলো অর্পার। - তোমাকে একদিন মাটনকারী রান্না করে খাওয়াবো, সেদিন অবশ্যই তুমি খিচুড়ি রান্না করবে। কিন্তু সমস্যা হল ভালো মাটন গোস্ত চিনবো কীভাবে? সবসময় এটা আব্বুই দিয়ে যায়। - দিয়ে যায় মানে? - মানে হচ্ছে আম্মু আর আমি থাকি আম্মুর স্কুলের পাশে একটা ভাড়া বাসায়। আর আব্বু থাকে দাদা-দাদির সাথে নিজ বাড়িতে। সেখানে অবশ্য তার আরেকটা সংসার আছে। - মানে? - মানে? মা--নে, আমার যখন দুই বছর তখন আম্মু টের পায় আমার আব্বুর এক্সট্রা এফেয়ারের কথা। আমি হয়েছিলাম আব্বু আম্মুর বিয়ের পাঁচ বছর পর। তারমানে আম্মুর এই সাত বছরের বিশ্বাসে প্রথম ফাটল খেয়াল করে জানিয়েছিল সবাইকে । এরপর পারিবারিকভাবে অনেক চেষ্টা তদবির চলল ওই সম্পর্ককে ধামাচাপা দেওয়ার । কিন্তু আমার যখন ছয় বছর বয়স তখন একদিন একটা দুই বছরের মেয়ে সহ আব্বু তার ওই ওয়াইফকে নিয়ে বাসায় এসে উপস্থিত হলেন। আম্মু সেদিন তাৎক্ষনিকভাবেই জীবনের চরম সত্যকে মেনে সঠিক সিদ্ধান্তটা নিয়ে আমাকে সাথে করে বেড়িয়ে এসেছিল সেই বাড়ি থেকে। আব্বু দাদা-দাদি নানা নানি সবাই চেষ্টা করেছিলেন আম্মুকে মানিয়ে সবাই মিলে যেনো একই বাড়িতে থাকে । কিন্তু আমার আম্মু আর তা মেনে নেয়নি। - একদম ঠিক করেছেন আন্টি, কেন মেনে নিবেন তিনি? - আম্মু ডিভোর্স চেয়েছিল, কিন্তু আব্বু দেয়নি। পারিবারিকভাবেও আম্মুকে তখন চাপ দিল যাতে ডিভোর্সটা না হয়। আম্মুর ভয় ছিল যদি ডিভোর্স হওয়ার পর আমাকে আব্বু নিয়ে যায়। তাই আর আম্মু এ বিষয়টা নিয়ে এগোয়নি। সেই থেকে সেপারেশনে আছে আম্মু, কিন্তু আমি আর সেপারেশনে যেতে পারলাম না এমন বিশ্বাসঘাতক বাবার কাছ থেকে। নিয়তি বড় নির্দয় আচরন করে ছোট বাচ্চাদের সাথে। তাদের চাওয়া পাওয়া বলে কিছু থাকতে নেই। তাদের কোনো অধিকার নেই। তারা থাকে শুধু বড়দের হাতের পুতুল হয়ে। যেমনটা আমি এখন আছি। চাইলেও মন থেকে আব্বুকে মুছে ফেলতে পারি না। ধর্মও নাকি সেই অধিকার আমাকে দেয়নি। বড় অদ্ভুত সব নিয়মকানুন। - আপনি মন ছোট করছেন কেন? - আমিতো জন্ম সূত্রেই মনছোট মানুষ। - মোটোও না, আপনি একজন পরোপকারী মানুষ। এমন মানুষ কখনো ছোটমনের মানুষ হয় না। - সত্যি বলছো? আর উত্তরটা শুনতে পারল না। বোটটা এসে ধাপ করে বাড়ি খেল পাড়ে। অর্পা ভয়ে এক চিৎকার দিয়ে উঠল। আসলে কথা বলতে বলতে এলোমেলো প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে কখন বোটটা এক পাড়ে এসে ঠেকেছে তা কেউই খেয়াল করেনি। তন্ময়ও হঠাৎ ধাক্কায় কেঁপে উঠল। বোটটা একটা কিছুতে বেজে গেছে তাই আর মুভ করতে পারছে না দেখে তন্ময় খুব সাবধানে বোট থেকে নেমে ওটার পথটা ক্লিয়ার করল। আর তখনই অর্পা নিজে প্যাডেল ঘুরিয়ে ক্ষানিকটা দূরে সরে এল। তন্ময় "আরে আরে" করে উঠতেই ও আরও মজা পেয়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে আরও একটু দূরে গেলো। তন্ময় ওকে ধরার চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হচ্ছিল তখন অর্পা খুব মজা পাচ্ছিল আর তাই খিলখিল করে হাসতে শুরু করল। একটা সময় তন্ময় মুগ্ধ হয়ে ওর হাসি দেখতে লাগল। আজ সত্যি সত্যিই ওকে একটা ফে'রী বলেই মনে হচ্ছে যে কি না একটু আগেই বলেছে যে ওর মনটা ছোট না। কি মনে হতেই একটা চিৎকার দিয়ে বলে উঠল - এএএএএএএই মেএএএএএএয়েএএএএএএ..... আর বলতে পারল না। থেমে গেল। - কীইইইই? অর্পাও জোরে জানতে চাইল বাকি টা। - তুমি কী আমার হবে? কথাটা এতটাই আস্তে বলল তন্ময় যে অর্পা সে কথাটা শুনতে পেল না। এতক্ষণ জীবনমুখী লেখিকা সায়লা সুলতানা লাকী'র নতুন উপন্যাস "ভুলগুলো সব ফুল হয়ে থাক" এর কিছু অংশ পড়লেন । অর্পা কী শেষ পর্যন্ত তন্ময়ের হয়েছিল? ও কী ওর ভালোবাসাটুকু ব্যক্ত করতে পেরেছিল?কেমন ছিল ওদের পুরো জার্নিটা? এসব উত্তর নিয়ে রোমান্টিক জনরা এই উপন্যাসটি বই আকারে আনছেন অনুজ প্রকাশনা এবারের বই মেলায়।
সায়লা সুলতানা লাকী ১৯৭৬ সালের ২৬শে আগষ্ট, ঢাকায় জন্ম গ্রহন করেন। লেখিকার গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার ধাইদা গ্রামে ছিল যা এখন নদী গহ্বরে বিলীন হয়ে গেছে। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে তিনিই সবার বড়। বাবা আব্দুল লতিফ চাকলাদার সরকারি চাকরিজীবি ছিলেন। সেই সুবাদে ময়মনসিংহেও কেটেছে জীবনের কিছুটা সময়। মা মরহুমা শামসুন্নাহার নিহার ছিলেন খুবই শিল্পীমনা একজন মানুষ। তাঁর কাছ থেকেই গল্পের বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হয় লেখিকার। পড়াশোনা তাঁর খুব ভালো লাগে। শিক্ষা জীবনে প্রানিবিদ্যায় বিএসসি (অনার্স) ও এমএসসি (ফিশারিজ) সম্পন্ন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রানীবিদ্যা বিভাগ হতে ফিশারিজে এম ফিল ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।