“সংস্কৃতি কথা" বইটির ফ্ল্যাপ এর লেখাঃ পণ্ডিতেরা সংস্কৃতির বিভিন্নতা নিয়ে বড়াই করতে পারেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা এক ও অবিভাজ্য। আগুন জ্বালানাে আসল কথা; কোন কাঠে আগুন জ্বললাে সেদিকে না তাকালেও চলে। তবু যে আমরা তাকাই তার কারণ অহংপ্রীতি। আমার আনা কাঠে, না অপরের আনা কাঠে আগুন জ্বললাে, খামাখা তা ভেবে আমরা সারা হই এবং নিজেকে সঙ্কুচিত করতে থাকি। সঙ্কোচন যে পীড়ন সে কথা ভুলে যাই, বরং তা নিয়েই এক প্রকার গর্ব অনুভব করি। এই সঙ্কোচনের অপর নাম মানসিক ছুঁৎমার্গ আর মানসিক ছুঁৎমার্গ যে মানসিক মৃত্যু এ কথা সহজেই স্বীকার্য। পরিবেষ্টনের সঙ্গে প্রীতির যােগে যে চিত্তের সমৃদ্ধি তাতেই সংস্কৃতির উৎপত্তি। সুতরাং এখানে সেখানে এক-আধটু রংয়ের পার্থক্য থাকলেও আসল জিনিসটা এক। পরিবেষ্টন : আধার ; প্রেম : তৈল ; চিত্ত : সলতে; আর সমৃদ্ধি বা সংস্কৃতি : আলােক। অতএব কি নামীয় আধারে আলাে জ্বললাে, এ নিয়ে যাঁরা তর্কে প্রবৃত্ত হন, তাঁদের তার্কিক বলা গেলেও প্রেমিক বলা যায় না-আলাের ক্ষুধা বা আলাের প্রীতি তাঁদের জীবনে বড় হয়ে উঠে নি বলে। নামের তারতম্যে আধারের যে বিভিন্নতা, electric lightএর আমদানীতে তা-ও লুপ্ত হতে চলেছে। বিজ্ঞানের জয়যাত্রা আজ অপ্রতিহত আর বিজ্ঞান যে নির্বিশেষ এ সহজ সত্য। জীবনের উপর বিজ্ঞানের প্রভাব ক্রমাগত বেড়ে চলেছে বলে জীবনের অমৃতময় ফল সংস্কৃতিও নির্বিশেষ বা সাধারণ হতে চলেছে। অতএব তাকে স্বাগতম’ বলে অভ্যর্থনা করা উচিত।
মােতাহের হােসেন চৌধুরী (১৯০৩-১৯৫৬) জীবদ্দশায় পরিচিত মণ্ডলে এবং সাধারণ পাঠকদের মধ্যে বিশেষ শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। সমাজ ও রাষ্ট্রের যদি নূন্যতম আনুকূল্য পেতেন তা হলে জীবৎকালেই তাঁর দু’চারটি বই প্রকাশিত হতাে। অতীব দুঃখের বিষয় মৃত্যুকালে তার কোনাে প্রকাশিত গ্রন্থ ছিল না। সাহিত্যজীবনের নানা পর্যায়ে মােতাহের হােসেন চৌধুরী একাধিক নামে পত্রপত্রিকায় লিখেছেন, যেমন- মােতাহের হােসেন বি. এ, সৈয়দ মােতাহের হােসেন চৌধুরী বি.এ, মােতাহের হােসেন চৌধুরী এম. এ, মােতাহের হােসেন। চৌধুরী প্রভৃতি। শেষ জীবনে শুধু মােতাহের হােসেন চৌধুরীই লিখতেন। চাকরি-বাকরিসংক্রান্ত ও ব্যক্তিগত কোনাে প্রয়ােজনে তিনি তাঁর পিতৃদত্ত নাম সৈয়দ মােতাহের হােসেন চৌধুরী লিখতেন। তার পৈত্রিক বাড়ি নােয়াখালী জেলার রামগঞ্জ থানার কাঞ্চনপুর গ্রামে। পিতা সৈয়দ আবদুল মজিদ চৌধুরী ছিলেন একজন সাব-রেজিস্ট্রার। খ্রিস্টীয়-ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে এটি ছিল সম্মানজনক চাকরি । তাদের পারিবারিক সূত্র থেকে জানা যায়, ফিরােজ শাহের রাজত্বকালে শাহ সৈয়দ আহমদ তনুরী ওরফে শাহ মিরান নামে একজন সুফি সাধক ইরাক থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এই উপমহাদেশে আসেন। মােতাহের হােসেনের মাতামহ মৌলবী আশরাফ উদ্দিন আহমদের বাসভবন ছিল কুমিল্লা শহরের ‘দারােগা-বাড়ি'। এই দারােগা-বাড়িতেই মােতাহের হােসেনের জন্ম। তাঁর নিজের হাতে লেখা পুরনাে কাগজপত্র দেখে প্রবন্ধ-সমগ্রের সম্পাদক সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রমাণ পেয়েছেন তাঁর জন্মতারিখ : ১ এপ্রিল ১৯০৩।