“মগের মুল্লুকের” অর্থনীতি বইয়ে মার্কেটিং ও অর্থনীতির কিছু আলোচিত, সমালোচিত এবং বিতর্কিত ধারণার কার্যকারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে । কয়েকটি আলোচিত অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি সম্পর্কে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে যে, ব্যবসা ও অর্থনীতি বিষয়ে আমরা গণমাধ্যম থেকে যেসব চাঞ্চল্যকর খবর পাই তার বেশিরভাগের সাথেই ব্যবসা এবং অর্থনীতির বিশেষ সম্পর্ক নেই। বহুমাত্রিক স্বার্থের সংঘাতে প্রতিপক্ষ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জনমত তৈরি করে প্রভাবশালী গণমাধ্যম। অতঃপর জনমত অনুকূলে রাখতে সরকার একটা অর্থনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান দেয়। কিন্তু আমজনতা এসব খবরের সত্যতা যাচাই করতে পারে না। তাই সরকার কার্যত সাংবাদিক, সম্পাদক বা গণমাধ্যম মালিকদের প্রত্যাশা অনুযায়ী সমাধান দেয়, যা বাস্তবে গণবিরোধী। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মিডিয়া মালিকরা একই সাথে বিভিন্ন ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক। এ ছাড়া ওষুধ, আবাসন, আমদানি-রপ্তানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রকল্পে বিনিয়োগ আছে প্রভাবশালী গণমাধ্যম মালিকদের। ব্যাংক ঋণ ও ঋণপত্রের যোগান নিয়ে গণমাধ্যম মালিকদের মধ্যে দা-কুমড়া সম্পর্ক। গণমাধ্যমের আয়ের প্রধান উৎস বিজ্ঞাপন। ডেটা-নির্ভর মার্কেটিং প্রযুক্তির যুগে টেলিভিশন বা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেয়া বেশিরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য অলাভজনক এবং অনিশ্চিত বিনিয়োগ। গণমাধ্যম বিজ্ঞাপনের চেয়ে ফ্রিল্যান্স অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং ফোর্স অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য কার্যকর বিকল্প। কারণ ফ্রিল্যান্স সেলস ফোর্সকে বিক্রি নিশ্চিত করার আগে কোনো কমিশন বা লভ্যাংশ দিতে হয় না। গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিতে ব্যবসায়ীদের বাধ্য করা হয়। গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন না দিয়ে বিক্রয় করা যায়, এমন সব বিপণন পদ্ধতিকে “প্রতারণামূলক পঞ্জি স্কিম” এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে “অবৈধ ব্যাংকিং” বলে জনমত তৈরি করে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম। তবে প্রতারণা বা অবৈধ ব্যাংকিং নয়, দিনশেষে বিতর্কিত এমএলএম, ই-কমার্স, ব্যাংক, বিমা, সমবায় সমিতি, সবার বিচার করা হয় অর্থ পাচার আইনে। হুন্ডি এবং আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে পণ্যের দাম কম বা বেশি দেখিয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে অর্থ পাচার হয়। কিন্তু তার প্রমাণ সংগ্রহ করা দুনিয়ার বড় বড় ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির পক্ষেও সম্ভব নয়। অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়া শুধু গণমাধ্যমের খবরের ভিত্তিতে লোক দেখানো বিচার প্রক্রিয়ায় একের পর এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার ধারাবাহিকতায় দেশের সব ধরনের ব্যবসা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান গণমাধ্যম-প্রশাসনের অসাধু চক্রের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে। দুর্নীতিপরায়ণ গণমাধ্যম মালিকদের সীমাহীন দৌরাত্ম্যে ব্যবসা-বাণিজ্য “জোর যার মুল্লুক তার” নীতিতে চলে। আমি সংশ্লিষ্ট ব্যবসা বা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত না, এই অজুহাতে একটা অনাচারকে সমর্থন দিতে দিতে আজ আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য নীতির নাম “মগের মুল্লুকের” অর্থনীতি। “একটা অবিচার সর্বত্র ন্যায়বিচারের জন্য হুমকি। আমরা পারস্পরিক সম্পর্কের এক অলঙ্ঘনীয় জালে আটকা, নিয়তির অভিন্ন পোশাকে বাঁধা, যা একজনকে প্রত্যক্ষভাবে আঘাত করে, পরোক্ষভাবে সবাইকে আঘাত করে”- মার্টিন লুথার কিং।