পাথুরে মাটির কৃষাণ’ আনোয়ার হোসেন বাদলের সেই উপন্যাস যেখানে আছে টিকে থাকার লড়াই, দুর্নীতির থাবা, মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগ ও প্রত্যাশার ফাটল, আছে কিছু হৃদয়বান মানুষের আশ্রয় আর নদী ভাঙনের ছোবল। একটি ভালো উপন্যাসে আমরা অবশ্যই চাইবো সমাজের ভালো-মন্দ আদলের সবটুকু রূপায়ন। ‘পাথুরে মাটির কৃষাণ’ সে ক্ষেত্রে এক অপূর্ব সংযোজন। দক্ষিণাঞ্চল দ্রোহ আর প্রেমে বরাবরই উর্বর। একদিকে সবুজের সামিয়ানা অন্যদিকে নদী ভাঙনের হাহাকার। একদিকে প্রতারণা, হয়রানী অন্যদিকে সর্বরিক্ত মানুষের হাত ধরে বাঁচার সংগ্রামে কতিপয় হৃদয়বান মানুষ। আনোয়ার হোসেন বাদলের চারপাশে থাকা এইসব মানুষই, ‘পাথুরে মাটির কৃষাণের’ চরিত্র হয়ে উঠেছে। সমাজের কালোসাদা, অন্ধকার-আলো আনোয়ার হোসেন বাদলের উপন্যাসকে এতটাই কাছের করে তলেছে যে, মনে হচ্ছে একজন প্রক ু ৃত লেখকের কলম থেকে এই ধাক্কাটা দরকার ছিলো। উপন্যাসের শুরুতে কলকাতা যাবার ভ্রমণযাত্রী হিসেবে যে জমিরুদ্দিনকে দেখা যায় উপন্যাসের শেষে তাকেই দেখা যায় অনেক উত্তর মিলিয়ে দিচ্ছেন দায়িত্ব নিয়ে। জমিরুদ্দিনই এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, যে বিবেকের গান হয়ে পাহারাদার হয়ে উঠেছেন। আত্মসমালোচনার চাবুক উপন্যাসের গতিকে দুর্বার করেছে। রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক গাঢ়তা। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বেঁচে থাকার ঐশ্বর্য। এখানেও রয়েছে সত্য, অসত্য কুহক। কখনো কখনো সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় আড়ালেই থেকে যায়। একজন শহিদ মুক্তিযোদ্ধার মা বানেছা বুড়ি তাই ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করে। মুক্তিযুদ্ধের কথা এলেই সেখানে থাকবে রাজাকার অরেছ শিকদারের মতো চরিত্র যাদের দেখলে আজও ঘৃণার সমুদ্র জেগে ওঠে বানেছা বুড়ির শরীরে। চাঁন গাজী, লালু শরিফ, প্রতিবাদী যুবক রুস্তম মোল্লা, জেলে জীবন, নদীর তীব্র ভাঙন খেলা, খেটে খাওয়া মানুষের প্রতিদিনের সংগ্রাম আনোয়ার হোসেন বাদলের উপন্যাসকে দিয়েছে উত্তাল উত্তাপ। সেই ধারাবাহিকতায় গভীর অনুরাগ জ্যোৎস্না জামিলা। যা বিরহের জলে ধোয়া এই কঠিন জীবনের শরীরে দিয়েছে মধুর টান। সমাজের নিয়মে তৈরি দেয়াল বুঝিয়ে দেয় অসম, অসার প্রতিদিনের ক্ষত। আনোয়ার হোসেন বাদলের উপন্যাস, ‘পাথুরে মাটির কৃষাণ’ অনেক ছোট ছোট কাহিনি, নানা মানুষ, ভ্রমণপথের বর্ণনায় সমৃদ্ধ। প্রকৃতি, প্রেম, রাজনীতি, প্রতিবাদ, সরলতায় জীবন্ত এই উপন্যাস হৃদয়বান পাঠকের কাছে পৌঁছে যাবে আমার বিশ্বাস। আসমা চৌধুরী ০৮.০৮.২০২২
কবি ও উপন্যাসিক আনোয়ার হোসেন বাদল, দখিন জনপদের পায়রা তীরবর্তী পটুয়াখালীর রাজগঞ্জ গ্রামের মানুষ। গ্রামটি অনেক আগেই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। কবির বাপজান জয়নাল আবেদীন মুন্সী স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম ছিলেন মা হালিমা খাতুন পরহেজগার একজন বিদুষী মহিলা। লেখনীর মধ্যে বরাবরই উঠে এসেছে ভূমিহীন প্রান্তিক মানুষের কথা, লেখক নিজেও তাদেরই একজন। সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শে বড় হয়েছেন সঙ্গত কারণেই ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক জীবনের লড়াই। সামরিক, বেসামরিক নানাবিধ পেশায় কাজ করে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা কুড়িয়েছেন লেখক যা তাঁর লেখায় দৃশ্যমান। নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া ভূমিহীন এ মানুষটির আর্থিক টানাপোড়েন কোনোদিনই পিছু ছাড়েনি, তবু এই দৈন্যতাকে তিনি খোদার আশীর্বাদ হিসেবে নিয়েই মাথা উঁচু করে পথ চলেছেন।