ফ্ল্যাপে লিখা কথা বাউল (বাউলদের উপর একটি গবেষণামূলক বই) ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ প্রকাশের মধ্য দিয়েই মূলত জসীম উদ্দিনের কাব্যকীর্থির সমধিক বরণ্ অতীতে বাংলা সাহিত্যে পল্লী তীর্থকামীর সন্ধান মিললেও তাঁর রচনায় পাওয়া যায় গ্রাম-জীবন ও প্রকৃতি-চারণের রূপ-উছল চিত্রায়ণ। আর তাতে সময় পরম্পরায় যুক্ত হতে থাকে বিষয়ের বিশ্লেষণধর্মিতা, ভাষার পরিপাট্যম সৌন্দর্যবোধ এবং পরিমার্জনপ্রিয়তার সমুদয় লক্ষণ। সত্যিকার অর্থে গ্রাম্য-প্রকৃতির রূপবন্দনায় এই কবির শ্রেষ্ঠত্ব আজ অবধি শীর্ষচূড়া- সমান। তা সম্ভব হয়েছিল অন্য এক ইতিহাসের কারণে। প্রথম জীবন থেকেই জসীম উদ্দিন লোকসাহিত্যের সাথে ব্যাপক ও গভীর পরিচিতি হওয়ার মানসে দেশের নানা প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর দৃষ্টি যায় মধ্যযুগের চণ্ডীমঙ্গল, বৈষ্ণব পদাবলী, ময়মনসিংহ গীতিকাসহ বিভিন । অঞ্চলের প্রচলিত বৈচিত্র্যপূর্ণ পল্লী গীতির দিকেও। ফলে যে-প্রাণৈশ্বর্যে সাক্ষাৎ তিনি পেয়েছিলেন, কবির মৌলিক রচনাকে তা প্লাবিত করেছে বার বার। অন্যদিকে লোকগীতি-গাথার অবদান যে অনস্বীকার্য সেকথা ভেবেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ স্বর্গীয় দীনেশচন্দ্র সেনের সুপারিশে জসীম উদ্দীনকে পল্লীগীতি সংগ্রাহক নিযুক্ত করা হয়। এ ধারায় তিনি কিন্তু সাধারণ পল্লীগীতি সংগ্রাহক মাত্র ছিলেন না, উচ্চমানের গবেষকের মতো বিরল তত্ত্ব, তথ্য ও রসবোধের অধিকারী পুরুষও হয়ে উঠেছিলেন। ‘বাউল’ বইটিও সে প্রান্তেরই এক সংযোজন। বাউলদের ঘিরে অতীতে তেমন বিস্তৃত আলোচনা ঘটেনি। H.H. Wilson তাদের সম্পর্কে বলেন ‘এই বাউলেরা তাদের সম্পর্কে বলেন, ‘এই সম্প্রদায়ের কিছু জানা যায় না।’ আবার দেখা যায়, বাউলেরা তাদের বিষয়-আশয় গোপন রাখাই প্রয়াস পেয়েছে। হয়ত চণ্ডিদাসও সেইজন্যে বলেছিলেন, ‘যাইতে উত্তরে বলিবে দক্ষিণে/দাঁড়ায়ে পুব মুখে’। তবে জসীম উদ্দীন আলোচ্য গ্রন্থে শুধু কয়েকটি গান সংগ্রহই নয়, বাউলদের তাবৎ রসহ্য-উদ্ধারেও ব্রতী হয়েছেন যা অনুসন্ধানী পাঠক-পাঠিকার অজস্র প্রশ্নের জবাব দিতে পারে।
কবি জসীম উদ্দীন ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পার্শ্ববর্তী গোবিন্দপুর গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে তাঁর শৈশব কাটে। তাঁর পিতা আনসার উদ্দীন সেখানে একজন স্কুল শিক্ষক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তিনি এলাকায় প্রেসিডেন্টও ছিলেন। কবির মাতা রাঙাছুটু ছিলেন একনজন গৃহবধূ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রী অধ্যয়নকালে ও লাভের পর জসীম উদ্দীন প্রখ্যাত পণ্ডিত ড. দীনেশচন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে ‘রিসার্চ ফেলো’ পদে কর্মরত ছিলেন । দীনেশ সেন সেই দিনগুলোতে বাংলাদেশের বিভিন্ন পল্লী এলাকার মানুষের মুখে গীত-পঠিত পুথি সংগ্রহ ও গবেষণা করতেন । ড. সেন তার উপযুক্ত শিষ্য জসীম উদ্দীনকে বাংলার জেলাগুলোর বিশেষভাবে ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ জেলার সেইসব পুঁথি (কাব্য-লোকগাথা) সংগ্রহের দায়িত্ব দেন। জসীম উদদীন পুথি সংগ্ৰহকালে গ্রামীণ জনগণের আনন্দ-বেদনার কাব্যগাথার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন, মানুষকে ভালোবেসে একজন খাটি মানবপ্ৰেমী হয়ে ওঠেন। কবি পালাগান, গাজীর গান, জারীগান, লোকগীতির আসরে যেতেন, উপভোগ করতেন, মাঝে মাঝে নিজের বাড়িতেও লোকসঙ্গীতের আসরের আয়োজন করতেন । লোকগীতিতে সুরারোপ করেন ও বিশিষ্ট শিল্পীদের গান শেখান এবং পরবর্তীকালে কিছুকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন । লোকসংস্কৃতির উপাদান প্রত্যক্ষ করেন। জসীম উদদীন কবিতা, নাটক, উপন্যাস, কাব্যোপন্যাস, প্ৰবন্ধ, ত্য গবেষণাগ্রন্থ, গান, ভ্রমণকাহিনী এবং ও স্মৃতিকথাসহ অর্ধশতাধিক বইয়ের রচয়িতা। কবি দুইবার এডিনবাৰ্গ উৎসবে (১৯৫০ ও ১৯৬২ সালে) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভয়াসহ বহু দেশে অনেক লোকসংস্কৃতি উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর গ্রন্থগুলো বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে : ১৯৭০ সালে UNESCO তাঁর “সৌজন ব্যাদিয়ার ঘাট” ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ ও প্ৰকাশ করে । কবির ’মাটির কান্না’ কাব্যগ্রন্থটি রুশ ভাষায় একটি সংস্করণ বেরিয়েছে। ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ কবি ইহলোক ত্যাগ করেন ।