সাহিত্য কোনো দৈববাণী নয়; নয় তা কোনো ঐশী সাধনালব্ধ সম্পদ। বরং তা একান্তভাবেই ব্যক্তির অনল সশ্রম ও নিরস্তর প্রচেষ্টা-প্রযত্নের ফল। সাহিত্য তার স্রষ্টার অস্তিত্বানুগ ও অস্তিত্ববিরোধী মনোভাবের শব্দরূপ; প্রতিকূল ও অনুকূল পরিবেশে তার সমবেদনাময় ও সংগ্রামশীল জীবনালেখ্য; তারই পরাজিত ও বিজিত, পীড়িত ও বিক্ষুব্ধ, আনন্দিত ও উচ্ছ্বসিত, সংহত ও দীর্ঘশ্বসিত জীবনের ইতিকথা। জীবন আবার দেশ-কাল নির্ভর, ঐতিহ্য আলোকিত, সময়-সচেতন ও সমকাল শাসিত। সাহিত্য তাই সাহিত্যকারের বহু কৌণিক ব্যক্তিত্বের শিল্পরূপ; তারই অভিজ্ঞতাস্রিগ্ধ জীবনের আগ্নেয় উদ্ভাসন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবনকথাকে চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায় প্রথম পর্যায় : ১৯২২ থেকে ১৯৪৩ এ বি. এ. পাশ পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্যায়: ১৯৪৩ এ বি. এ. পাশ উত্তর সময় থেকে ১৯৪৭ এ স্টেট্স ম্যানের চাকরি থেকে পদত্যাগ পর্যন্ত। তৃতীয় পর্যায়: ১৯৪৭ এ ঢাকা আগমন থেকে ১৯৫০ এ রেডিও পাকিস্তান করাচি কেন্দ্রে বদলির পূর্ব পর্যন্ত। চতুর্থ পর্যায় : ১৯৫১ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত । প্রথম পর্যায় : ১৯২২-১৯৪৩ প্রথম পর্যায় হল সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র মনোগঠনের পরিপ্রেক্ষিত ও পটভূমি। এই কাল-পরিধিতে পারিবারিক ঐতিহ্যে তিনি লালিত ও প্রতিপালিত। এবং স্বকালের রাষ্ট্র ও সমাজমানসের তরঙ্গিত আবর্তের মধ্যে দিয়ে তিনি গ্রহণ করেছেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। উল্লেখযোগ্য যে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর পরিবার ছিল পূর্ববাংলার অভিজাত ও শিক্ষিত মুসলিম পরিবারগুলির অন্যতম। তাঁর পিতা সৈয়দ আহমদউল্লাহ্ ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির এম. এ. এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী। মাতামহ মৌলবী আবদুল খালেক সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে আইনের স্নাতক। ওয়ালীউল্লাহ্র মামী রাহাত আরা বেগম ছিলেন সে-কালের একজন খ্যাতকীৰ্ত্তি মুসলিম লেখিকা। রবীন্দ্রনাথের "নিশীথে' গল্প ও 'ডাকঘর' নাটকের উর্দু অনুবাদ তাঁর রবীন্দ্র-অনুরাগী হৃদয়ের পরিচয়বাহী।
Syed Waliullah (তাঁর জন্ম চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর এলাকায়, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট) তাঁর পিতা সৈয়দ আহমাদুল্লাহ ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা; মা নাসিম আরা খাতুনও সমতুল্য উচ্চশিক্ষিত ও রুচিশীল পরিবার থেকে এসেছিলেন, সম্ভবত অধিক বনেদি বংশের নারী ছিলেন তিনি। ওয়ালীউল্লাহর আট বছর বয়সের সময় তার মাতৃবিয়োগ ঘটে। দুই বছর পর তার বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। বিমাতা এবং বৈমাত্রেয় দুই ভাই ও তিন বোনের সঙ্গে ওয়ালীউল্লাহর সম্পর্ক কখনোই অবনতি হয় নি। তার তেইশ বছর বয়সকালে কোলকাতায় চিকিৎসা করতে গিয়ে মারা যান। তার পিতৃমাতৃবংশ অনেক শিক্ষিত ছিলেন। বাবা এম এ পাশ করে সরাসরি ডেপুটি মেজিস্ট্রেট চাকুরিতে ঢুকে যান; মাতামহ ছিলেন কোলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে পাশ করা আইনের স্নাতক; বড়ো মামা এমএবিএল পাশ করে কর্মজীবনে কৃতি হয়ে খানবাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন এবং স্ত্রী ওয়ালীউল্লাহর বড়ো মামী ছিলেন নওয়াব আবদুল লতিফ পরিবারের মেয়ে, উর্দু ভাষার লেখিকা ও রবীন্দ্রনাথের গল্প নাটকের উর্দু অনুবাদক। ১৯৩৯ সালে তিনি কুড়িগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় হতে ম্যাট্রিক, এবং ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তার আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিলো ডিস্টিঙ্কশনসহ বিএ এবং অর্থনীতি নিয়ে এমএ ক্লাশে ভর্তি হয়েও শেষে পরিত্যাগ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ওয়ালীউল্লাহ ঢাকায় এসে প্রথমে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সহকারী বার্তা-সম্পাদক ও পরে করাচি কেন্দ্রের বার্তা-সম্পাদক (১৯৫০-৫১) হন। ১৯৫১-৬০ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সরকারের পক্ষে নয়াদিল্লি, সিডনি, জাকার্তা ও লন্ডনে বিভিন্ন উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি প্যারিসে পাকিস্তান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং ১৯৬৭-৭১ সাল পর্যন্ত ইউনেস্কোর প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট ছিলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দুটি গল্পগ্রন্থ নয়নচারা (১৯৫১), দুই তীর ও অন্যান্য গল্প এবং তিনটি নাটক বহিপীর (১৯৬০), তরঙ্গভঙ্গ (১৯৬৪) ও সুড়ঙ্গ (১৯৬৪) রচনা করেছেন। ছোটগল্প ও নাটকেও তিনি সমাজের কুসংস্কার, ধর্মীয় ভন্ডামি, মানসিক ও চারিত্রিক স্খলন ইত্যাদিকে প্রতিভাসিত করেছেন। তিনি দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্য পুরস্কার এবং বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর, ১৯৮৩) লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর প্যারিসে তাঁর মৃত্যু হয় এবং প্যারিসের উপকণ্ঠে মদোঁ-স্যুর বেল্ভু-তে তিনি সমাহিত হন।