বিশ শতকের শুরুতে নারীর নায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জোরালো ও ন্যায় সঙ্গত যুক্তির অবতারণার মাধ্যমে যে মহিয়সী আবিভর্‚ত হন সাহিত্য ও সমাজকর্মের অংগনে তিনি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং সুতীক্ষè লেখনীর মাধ্যমে একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে কর্মক্ষেত্রে এই তেজোদীপ্ত রমণীর আবির্ভাব। যে কালে রোকেয়ার জন্ম নারীশিক্ষা, নারী স্বাধীনতা, সুকুমার শিল্পে নারীর আত্মনিবেদন এবং প্রতিষ্ঠার কল্পনা ছিল কেবল আকাশ-কুসুম ভাবনা। সত্যিকার অর্থে এমন কল্পনা করার দুঃসাহসও কারো ছিল না, বিশেষ করে কোনো নারীর। সে যুগে শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, শুধু সামাজিক নয়, অনেক ক্ষেত্রে মানুষের প্রাপ্য মর্যাদা থেকেও নারী ছিল ‘বঞ্চিত। যেখানে শিক্ষা দীক্ষাহীন নারী অবরোধ প্রথার কঠিন খোলসে ছিল আবদ্ধ। তখন নারীর জন্য সাহিত্য সাধনার কথা কল্পনা করাও ছিল অচিন্ত্যনীয়। এমনকি রোকেয়ার আগে এবং পরে শত বছর ধরে হিসাব করলেও এমন একটা চিত্র পাওয়া দুস্কর হবে যেখানে নারীর যথাযথ মূল্যায়ন হয়েছে। নারীর এই অবরোধবাসের কালে একমাত্র বেগম রোকেয়াই আলোকবর্তিকা রূপে উদ্ভাসিত হয়ে নারীর কল্যাণার্থে সুকুমার সুশীল চিন্তা জগতে প্রাগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ ভ‚মিকা রাখেন। নারীমুক্তি আন্দোলনের উদ্যোক্তা রোকেয়ার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নারীকে শিক্ষিত করে তোলা। তাঁদের কে নিজ প্রজ্ঞা, অধিকার সম্পর্কে আত্মসচেতন করা এবং নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করা। আর এই মুক্তি অর্জনের জন্য রোকেয়া প্রধানত নারী শিক্ষার কথা বলেছেন। যে শিক্ষা কেবলমাত্র পাশ করা বিদ্যা বা অন্যের অন্ধ অনুকরণ নয় বরং প্রকৃত শিক্ষা এবং রোকেয়ার সাহিত্যকর্মের মধ্যে দিয়েই তাঁর এই অভিমত ব্যক্ত হয়েছে, যখন তিনি বলেন- ঈশ্বর আমাদিগকে হস্তপদ চক্ষু কর্ণ মন এবং চিন্তা শক্তি দিয়েছেন। যদি আমরা অনুশীলন দ্বারা হস্তপদ সবল করি, চক্ষু দ্বারা মনযোগ সহকারে দর্শন করি, কর্ণ দ্বারা মনযোগ পূর্বক শ্রবণ করি এবং চিন্তা শক্তি দ্বারা আরো দৃঢ়ভাবে চিন্তা করিতে শিখি, তাহাই প্রকৃত শিক্ষা। আমরা কেবল পাশ করা বিদ্যাকে প্রকৃত শিক্ষা বলি না। সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলিম নারীসমাজে আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসারই ছিল বেগম রোকেয়ার অন্তরের একান্ত কামনা। শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল অত্যন্ত সহজ এবং গতানুগতিকতার উর্ধ্বে। তিনি বলেন- ‘‘শিক্ষার অর্থ কোন সম্প্রদায় বা জাতি বিশেষের অন্ধ অনুকরণ নয়।’’ অর্থ উপার্জন করাই যে শিক্ষা লাভের মূল উদ্দেশ্য, বেগম রোকেয়া তা কোনদিনও স্বীকার করেননি। তাঁর মতে, লেখাপড়া পরীক্ষা পাশের জন্য না হয়ে জ্ঞান লাভের জন্য হওয়া উচিত। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মানুষকে গড়ে তোলা। মেয়েদের সেই ধরনের শিক্ষা লাভ করতে হবে যাতে তাঁরা সংসার জীবনে আদর্শ গৃহিনী জননী ও আদর্শ স্ত্রী রূপে গড়ে উঠতে পারে। আধুনিক কালের বিভিন্ন জাত ধর্মের মেয়েদের মত মুসলিম মেয়েরাও যেন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যথাযোগ্য জায়গা দখল করতে পারে। তাই শুধু পুঁথিগত বিদ্যাই নয়, মেয়েদের নানাভাবে দেশের সেবা করা এবং পরোপকার ব্রতে উদ্বুদ্ধ করে তোলাই সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল স্থাপনের মহতী উদ্দেশ্য ছিল। আমরা জানি, যে সমাজে কন্যা পায় পৈত্রিক সম্পত্তিতে পুত্রের অর্ধেক, যে সমাজে নারীকে অবরোধবাসিনী বলে চিহ্নিত করা হয়, সেই সমাজের বিরুদ্ধে বেগম রোকেয়ার লেখনী সোচ্চার ছিল। আর সেই সমাজের শিকল কেটে রাজপথের আলোয় বের হতে প্রথম কাজ হলোÑ নারীর যোগ্যতা অর্জন, রোকেয়াসাহিত্যে তারই ইঙ্গিত অতি স্পষ্ট এবং তিনি মনেপ্রাণে এ কথা বিশ্বাস করতেন- যোগ্যতা অর্জনের জন্য, নিজের অধিকার ছিনিয়ে আনার জন্য নারীহৃদয়ে শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের বীজ বপন করা প্রয়োজন। যে বিশ্বাস আর শক্তি নিয়ে নারী পুরুষকে পরাভ‚ত করতে পারে। নারী পুরুষনির্ভর না হয়ে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারে। আর বেগম রোকেয়া স্পষ্টতই অনুধাবন করতে পেরেছিলেনÑ স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য আলস্য জড়তা পরিত্যাগ করে অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে নারীকে এগিয়ে যেতে হবে। রোকেয়ার লেখনীতে আমরা পাই- বিপদ সংকুল সংসার হইতে সর্বদা সুরক্ষিত আছি বলিয়া আমরা সাহস ভরসা-বল একেবারে হারাইয়াছি। আত্মনির্ভরতা হারাইয়া স্বামীদের নিতান্ত মুখাপেক্ষি হইয়া পড়িয়াছি। বহুকাল হইতে নারী হৃদয়ের সুকুমার বৃত্তিগুলো অকালে বিনষ্ট হওয়ায় নারীর অন্তর বাহির মস্তিষ্ক সবই দাসী হইয়া পড়িয়াছে। এখন আর আমাদের স্বাধীনতা ও জাতীয়তা বলিয়া কোনো বস্তু নাই এবং তাহা লাভ করিবার কোনো প্রবৃত্তি পর্যন্ত লক্ষিত হয় না। জ্ঞান, কর্ম, নীতি ও স্বাধীনতায় নারীকে উদ্বেলিত করে নিজ হাতে নিজের অবস্থা মোচন করার ডাক দিয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। অন্যত্র তিনি বলেছেন, সাংসারিক জীবনে পুরুষের পাশাপাশি চলিবার ইচ্ছা অথবা দৃঢ় সংযম আবশ্যক এবং আমরা যে গোলাম জাতি নই, এই কথায় বিশ্বাস স্থাপন করিতে হইবে। পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয় তাহাই করিব। সুতরাং আমরা লক্ষ্য করি, বেগম রোকেয়া নারীর পৃথক সত্তা উদ্ভাবিত করার লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও আদর্শ সামনে রেখে তাঁর নারীমুক্তি আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন এবং তিনি অনেকখানি সফল হয়েছিলেন। আর এই সফলতার প্রতীকরূপ আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী। নারীশাসিত দেশে বাস করে আজ আমরা গর্বিত। আজ সমাজের সর্বস্তরে নারীরা প্রশাসনিক উঁচুপদে আসীন। নারী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট, ম্যাজিস্ট্রেট, ব্যারিস্টার ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। নারীশিক্ষা, নারীমুক্তির জন্য সরকার যেমন সচেষ্ট তেমনি সচেষ্ট পিতামাতা সকলেই। আজ আর নারীশিক্ষার পথে প্রতিবন্ধকতা নেই। নারীমুক্তির নামে কেউ আৎকে ওঠে না। কর্মক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি অবতীর্ণ হয়ে নারী এখন অর্থনৈতিক মুক্তির সাফল্য নিয়ে হাসছে। তাই বিশ শতকের তেজোদীপ্ত নারী বেগম রোকেয়া, নারীজাগরণ আর নারী মুক্তির সোচ্চার আন্দোলনের অগ্রদূতী রূপে খ্যাত। তীক্ষè মেধা, অসীম সাহস আর দীপ্ত বুদ্ধির অধিকারী এই মহিয়সী রমণী একাধিক পরিচয় নিয়ে অ¤øান অক্ষয় হয়ে আছেন কালের ইতিহাসে। সমাজসেবিকা রোকেয়ার পাশাপাশি সাহিত্যিক রোকেয়াও অধিষ্ঠিত আছেন বলিষ্ঠ এক আসনে। বেগম রোকেয়া তাঁর চিন্তা চেতনা ধ্যান ধারণাকে পরিস্ফুট করেছেন সাহিত্য সাধনার মধ্যে দিয়ে। সমাজসেবিকা রোকেয়া আর সাহিত্যিক রোকেয়াকে তাই আমরা এক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে পারি এবং রোকেয়াসাহিত্যের প্রতি দৃষ্টি দিলে আমরা স্পষ্টতই উপলব্ধি করতে পারি, রোকেয়া সাহিত্যের মূলসুর নারীমুক্তি। নারী জাতির অবরোধের যুগে জন্মেছিলেন রোকেয়া। শিকল পরিহিতা নারীদের মধ্যে তিনি নিজেও ছিলেন অবরোধবাসিনী। তথাপি নিজের কাজের প্রতি আত্মবিশ্বাস এবং প্রকট সাহস নিয়ে সমাজে ব্যঙ্গ-বিদ্রæপ আর তীব্র কষাঘাতের মাঝেও রোকেয়া কলম ধরেছিলেন। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার সোপান রূপে এই মহীয়সী রমনী তাঁর জোরালো লেখনীকেই বেছে নিয়েছিলেন। এক বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারিণী রোকেয়ার আবির্ভাব ঘটেছিল পশ্চাৎপদ মুসলমান সমাজে উনিশ শতকের শেষার্ধে এবং সমগ্র জীবনব্যাপী তাঁর আন্তরিক সাধনা ছিল অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ স্বগোত্রীয় নারী জাতির সর্বাংগীন উন্নতি বিধান এবং মুক্তি। নারীমুক্তির মাধ্যমে দেশ ও জাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে রোকেয়া তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ‘‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টর চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’’ এটাই সমাজ উন্নয়নের মূলমন্ত্র। বেগম রোকেয়া এটা অনুধাবন করেই পশ্চাৎপদ নারী জাতিকে জ্ঞান অর্জনে অগ্রগামী করে তুলতে চেয়েছিলেন। রোকেয়া যে নারী শিক্ষার কথা বলেছেন তা কেবলমাত্র পাশ করা বিদ্যা বা অন্যকে অন্ধ অনুকরণ নয়, বরং প্রকৃত শিক্ষা এবং রোকেয়ার সাহিত্যকর্মের মধ্যে দিয়েই তাঁর অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। যখন তিনি বলেন- ‘‘ঈশ্বর আমাদিগকে হস্ত, পদ, চক্ষু, কর্ণ, মন এবং চিন্তা শক্তি দিয়াছেন। যদি আমরা অনুশীলন দ্বারা হস্ত পদ সবল করি, চক্ষু দ্বারা মনোযোগ দর্শন করি, কর্ণ দ্বারা মনযোগ পূর্বক শ্রবণ করি এবং চিন্তা শক্তি দ্বারা আরও সূক্ষèভাবে চিন্তা করিতে শিখি তাহাই প্রকৃত শিক্ষা। আমরা কেবল পাশ করা বিদ্যাকে প্রকৃত শিক্ষা বলি না।’’ বাংলার মুসলমান নারী সমাজ তথা দেশ ও জাতির কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করে রোকেয়া অসীম পুণ্যের অধিকারী হয়েছেন। তাই তিনি একদিকে যেমন নারী জাগরণের অগ্রদূতী, অন্যদিকে তেমনি পুণ্যময়ী।
Title
নারীমুক্তি আন্দোলন বেগম রোকেয়া তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্ম