যে নারীকে অবলা ও ধর্মপথে পরিত্যাজ্য বলে মনে করা হয়, দেবী চৌধুরাণী সেই নারী সমাজের মস্তবড় প্রতিবাদ। 'দেবী চৌধুরাণী' উপন্যাসে কোনো বিচ্ছিন্ন কাহিনী নেই, কিন্তু একটি দীনাতিদীন মহামহীয়ান নারী হৃদয় সমস্ত কাহিনীর কেন্দ্রস্থলে। সংসার হতে নির্বাসিত, দরিদ্র, নিগৃহীত প্রফুল্ল স্বীয় রূপ-গুণ এবং বিদ্যা ও বুদ্ধিতে সংসারের প্রাণ কেন্দ্রে এসেছে। অর্থ দিয়ে উদ্ধার করেছে তাদের যারা তাকে বিতাড়িত করেছে, সপত্নীকে ভগিনীর অধিক ভালোবেসেছে, বুদ্ধি দিয়ে পরিচালিত করেছে দস্যুদলকে, কল্যাণীরূপে প্রজাসাধারণকে অনাহারে অন্ন দিয়েছে। এভাবে দেবী চৌধুরাণী উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র স্বধর্ম স্বদেশ ও স্বসংসার ক্ষেত্রে নারীর জীবনাদর্শকে উপস্থাপন করেছেন। উত্তরবঙ্গের পটভূমিতে লেখা এ উপন্যাসে অরণ্যের অন্ধকারে ঢাকা কোনো ভাববাদের উপক্রমণিকা নেই। মূল কাহিনীর নায়িকা প্রফুল্ল এবং উপকাহিনীর নায়ক ভবানী পাঠক ভৌগোলিক সীমানায় আবদ্ধ বাস্তব চরিত্র। চরিত্রকেন্দ্রিক উপন্যাসের নায়ক বা নায়িকা সাধারণত একমুখী, বৈচিত্র্যহীন, অর্থাৎ Flat Character. সময়ের পবিবর্তন তাদের মনে কোনো রেখাপাত করে না, তাদের চরিত্রের এই স্থায়ী আত্মিক রূপকে এডউইন ম্যুর বলেছেন mythical permanance. প্রধান কাহিনীর প্রফুল্ল, ব্রজেশ্বর, হরবল্লভ প্রভৃতি সকলেরই মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য। দেবী চৌধুরাণী উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র স্পষ্ট করে বলেছেন ব্যক্তি নিয়ে পরিবার, পরিবার নিয়ে সমাজ, সমাজ নিয়ে জগৎ। এবং সমস্ত কিছুকে বিধৃত করে আছেন পরম সত্তা। ‘দেবী চৌধুরাণী’ উপন্যাসের ঐতিহাসিক ভিত্তি সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, ‘দেবী চৌধুরাণী’ গ্রন্থের সঙ্গে ঐতিহাসিক দেবী চৌধুরাণীর সম্বন্ধ বড় অল্প। দেবী চৌধুরাণী, ভবানী পাঠক, গুডল্যাড সাহেব, লেপটেন্যান্ট ব্রেনান, এই নামগুলো ঐতিহাসিক। আর দেবীর নৌকায় বসে, বরকন্দাজ, সেনা প্রভৃতি কয়টা কথা ইতিহাসে আছে এই পর্যন্ত।' (ব. র, ভূমিকা: পৃ-২৩) ইতিহাসের ভবানী পাঠক ভোজপুরী ডাকাত। তার বাঙালিয়ানা, পাণ্ডিত্য ও আদর্শবাদ বঙ্কিমচন্দ্রের সৃষ্টি। বঙ্কিমচন্দ্রের কবিপ্রতিভা কিম্বদন্তীর ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরাণী দুটি নাম নিয়ে একটি মৌলিক মধুর তত্ত্ব আখ্যান রচনা করেছে মাত্র। তার সঙ্গে ইতিহাসের যোগ একেবারেই নেই বাস্তবের যোগও অনেক ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। বঙ্কিমচন্দ্র 'দেবী চৌধুরাণী' উপন্যাসে কল্পনার সাহায্যে মুঘল সাম্রাজ্যের অবসান এবং বৃটিশ শাসনের আরম্ভ এই রাজনৈতিক গোধূলি লগ্নে ফিরে যান, এবং একান্ত সত্যনিষ্ঠার সাথে সমসাময়িক অরাজক পরিস্থিতি চিত্রিত করেন। সে যুগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ভৌমিক নীতি ছিল অপরিকল্পিত ও অনিশ্চিত। প্রথমে প্রতি বছরে সর্বোচ্চ দরে জমিদারী ইজারা দেয়া হতো এবং পরে
Bankim Chandra Chattapadhyaya- জন্ম হয় বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের নিকটস্থ কাঁঠালপাড়া গ্রামে। তারিখ ২৬ জুন, ১৮৩৮ অর্থাৎ ১৩ আষাঢ় ১২৪৫। চট্টোপাধ্যায়দের আদিনিবাস ছিল হুগলি জেলার দেশমুখো গ্রামে। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রপিতামহ রামহরি চট্টোপাধ্যায় মাতামহের সম্পত্তি পেয়ে কাঁঠালপাড়ায় আসেন এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন। রামহরির পৌত্র যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তৃতীয় পুত্র বঙ্কিমচন্দ্র। বঙ্কিমের পূর্বে তাঁর আরও দুই পুত্র জন্মান – শ্যামাচরণ ও সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমের জন্মকালে তিনি সদ্য অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ডেপুটি কালেক্টর পদে উন্নীত হয়েছিলেন। জন্মের পর ছয় বছর বঙ্কিমচন্দ্র কাঁটালপাড়াতেই অতিবাহিত করেন। পাঁচ বছর বয়সে কুল-পুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেখড়ি হয়। শিশু বয়সেই তাঁর অসামান্য মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্কিমের কণিষ্ঠ সহোদর পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “শুনিয়াছি বঙ্কিমচন্দ্র একদিনে বাংলা বর্ণমালা আয়ত্ত করিয়াছিলেন।” যদিও গ্রামের পাঠশালায় বঙ্কিম কোনওদিনই যান নি। পাঠশালার গুরুমশাই রামপ্রাণ সরকার বাড়িতে তাঁর গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা থেকে মনে হয় তিনি রামপ্রাণের শিক্ষা থেকে বিশেষ উপকৃত হন নি। তিনি লিখেছেন, “সৌভাগ্যক্রমে আমরা আট দশ মাসে এই মহাত্মার হস্ত হইতে মুক্তিলাভ করিয়া মেদিনীপুর গেলাম।” ১৮৪৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র পিতার কর্মস্থল মেদিনীপুরে আনীত হলে, সেখানেই তাঁর প্রকৃত শিক্ষার সূচনা হয়। মেদিনীপুরের ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনৈক এফ টিডের পরামর্শে যাদবচন্দ্র শিশু বঙ্কিমকে তাঁর স্কুলে ভর্তি করে দেন। এখানেও বঙ্কিম অল্পকালের মধ্যেই নিজ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। পূর্ণচন্দ্রের রচনা থেকে জানা যায়, বার্ষিক পরীক্ষার ফলে সন্তুষ্ট হয়ে টিড সাহেব বঙ্কিমকে ডবল প্রমোশন দিতে উদ্যত হলে যাদবচন্দ্রের হস্তক্ষেপে তিনি নিরস্ত হন। ১৮৪৭ সালে টিড ঢাকায় বদলি হয়ে গেলে সিনক্লেয়ার তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন; তাঁর কাছেও বঙ্কিম প্রায় দেড় বছর ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৮৪৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্র পুনরায় কাঁটালপাড়ায় ফিরে আসেন। এইসময় কাঁটালপাড়ার শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে বঙ্কিম বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ নেন। বঙ্কিমচন্দ্র খুব ভালো আবৃত্তিকারও ছিলেন। সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জন নামক সংবাদপত্রে প্রকাশিত বহু কবিতা তিনি এই বয়সেই কণ্ঠস্থ করে ফেলেন। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর বিরচিত বিদ্যাসুন্দর কাব্য থেকে বিদ্যার রূপবর্ণন ও জয়দেব প্রণীত গীতগোবিন্দম্ কাব্য থেকে ধীরে সমীরে যমুনাতীরে কবিতাদুটি তিনি প্রায়শই আবৃত্তি করতেন। এছাড়াও পণ্ডিত হলধর তর্কচূড়ামণির কাছে এই সময় তিনি মহাভারত শ্রবণ করতেন। হলধরই তাঁকে শিক্ষা দেন - “শ্রীকৃষ্ণ আদর্শ পুরুষ ও আদর্শ চরিত্র”। এই শিক্ষা তাঁর পরবর্তী জীবনে রচিত নানা রচনাতে প্রতিফলিত হয়েছিল। কিছুকাল পরে ১৮৪৯ সালে হুগলি কলেজে ভর্তি হন। এখানে তিনি সাত বছর পড়াশোনা করেন। হুগলি কলেজ পড়াকালীন ১৮৫৩ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে মাসিক আট টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বছরেই সংবাদ প্রভাকরে কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কুড়ি টাকা পুরস্কার লাভ করেন। হুগলি কলেজ অধ্যয়নকালেই বঙ্কিমচন্দ্র কবিবর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জনে গদ্য-পদ্য রচনা আরম্ভ করেন। পরবর্তীকালে তাঁর বহু রচনা এই দুই কাগজে প্রকাশিত হয়। হুগলি কলেজ ১৮৫৬ সালে সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় সব বিষয়ে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করে তিনি দুই বছরের জন্য কুড়ি টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বছরই তিনি হুগলি কলেজ ছেড়ে আইন পড়বার জন্য কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৫৭ সালে জানুয়ারী মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা প্রবর্তন করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের আইন বিভাগ থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরের বছর ১৮৫৮ সালে প্রথমবারের মতো বি.এ. পরীক্ষা নেওয়া হয়। মোট দশজন ছাত্র প্রথমবারে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কেবলমাত্র বঙ্কিমচন্দ্র ও যদুনাথ বসু। তার বাবার মতো তিনিও সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টার পদে। সারা জীবন তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যান। স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে দুটি খেতাবে ভূষিত করে - ১৮৯১ সালে রায় বাহাদুর খেতাব এবং ১৮৯৪ সালে কম্প্যানিয়ন অফ দ্য মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার খেতাব। তবে সরকারি কর্মকর্তা নয় বরং লেখক এবং হিন্দু পুনর্জাগরণের দার্শনিক হিসেবেই তিনি অধিক প্রখ্যাত। শেষ জীবনে তাঁর স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো ছিল না। ১৮৯৪ সালের মার্চ মাসে তাঁর বহুমূত্র রোগ বেশ বেড়ে যায়। এই রোগেই অবশেষে তাঁর মৃত্যু হয়, এপ্রিল ৮, ১৮৯৪ (বাংলা ২৬ চৈত্র ১৩০০ সাল)