শাস্ত্রে, পুরাণে এবং মানুষের কাছে সীতার অবস্থান অতি উচ্চে। প্রায় দেবীর পর্যায়ে। তার পরও সীতার জীবন বিপন্ন-বিধ্বস্ত। জন্মের পরপরই জঙ্গুলে নির্জন এক ভূমিতে বিসর্জিত হয়েছে সীতা। কারা তার পিতা-মাতা ? সে কি পিতা-মাতার সামাজিক সন্তান নয়? পতিব্রতা, সর্বংসহা, সন্তান-অনুরাগী সীতাকে কেন রামচন্দ্র মর্যাদার আসন থেকে ধুলায় টেনে নামাল? হাতের নাগালে শতসহস্র রূপসি রমণী থাকা সত্ত্বেও রাবণ কেন সীতাকে অপহরণ করল? রাম কি বিশ্বাস করে বসেছিল, রাবণ কর্তৃক সীতা ধর্ষিতা? কোন কারণে সীতার অগ্নিপরীক্ষার আয়োজন করল রামচন্দ্র? গর্ভবতী সীতাকে অরণ্যে বিসর্জন দিল কেন রাম? রামচন্দ্র কি শুধু ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের মতো উঁচুবর্ণের মানুষদের রাজা ছিল? শূদ্রদের কী চোখে দেখত রাম? কেন রামচন্দ্র শূদ্রতপস্বী শম্বুককে হত্যা করল? রাম শেষ পর্যন্ত সীতাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিল না কেন? সীতার আত্মহত্যার জন্য কে দায়ী? রামচন্দ্র, না তৎকালীন ব্রাহ্মণ্যসমাজব্যবস্থা? এতদিন 'মহাভারত' নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন হরিশংকর জলদাস, এবারই প্রথম 'রামায়ণ' নিয়ে লিখলেন। তাঁর পৌরাণিক উপন্যাসগুলো শুধু ঘটনার বিবরণ নয়, তৎকালীন সমাজকে ফালা ফালা করে উপস্থাপনও । নতুন কথা শোনাবার জন্য হরিশংকর উপন্যাস লিখেন। ‘উপেক্ষিতা সীতা’ও তার ব্যতিক্রম নয়।
প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হরিশংকর জলদাস ১৯৫৫ সালের ১২ই অক্টোবর বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের উত্তর পতেঙ্গা গ্রামের এক জেলে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা যুধিষ্ঠির জলদাস পেশায় ছিলেন একজন জেলে। ফলে আর্থিক অভাব অনটন আর অর্থনৈতিক টানাপোড়েনই ছিল হরিশংকরের বেড়ে ওঠার সঙ্গী। হরিশংকর জলদাসের শৈশব-কৈশোর কাটে পতেঙ্গার কৈবর্তপাড়ায়। তার বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে জেলের জীবনযুদ্ধে না জড়িয়ে শিক্ষিত করবেন যেন ছেলে সম্মানের জীবনযাপন করতে পারে। হরিশংকরের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় দেবেন্দ্রলাল দে’র আদাবস্যার নামের এক পাঠশালায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে তিনি ভর্তি হন পতেঙ্গা বোর্ড প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৭১ সালে পতেঙ্গা হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে বাবার স্বপ্ন পূরণে আরো একধাপ এগিয়ে যান হরিশংকর। 'জাইল্যা' ঘরের সন্তান বলে তাকে বিভিন্ন সময়ে অপমানিত হতে হয়েছে, শুনতে হয়েছে ‘জাওলার ছাওয়াল’ কটুক্তি। সেই কথার উচিত জবাব দিতে তিনি ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ‘নদীভিত্তিক বাংলা উপন্যাস ও কৈবর্ত জনজীবন’ বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এখানে তিনি জেলেদের জীবনের সকল আনন্দ-বেদনা, উৎপত্তি-বিকাশ, তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন ইত্যাদি তুলে ধরেন। পেশাগত জীবনে হরিশংকর জলদাস চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান। কিন্তু কর্মজীবনের শুরুতে অভাবের দিনগুলোতে তিনি দিনে শিক্ষকতা এবং রাতে বাবার সাথে সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতেন। ৪৭ বছর বয়সে তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘জলপুত্র’ লেখেন। এরপর, ক্রমাগত বাজারে আসতে থাকে হরিশংকর জলদাসের নতুন বই। হরিশংকর জলদাসের বইগুলোতে সবসময়ই উঠে এসেছে নিপীড়িত, প্রান্তিক এবং নিচুতলার মানুষের কথা। হরিশংকর জলদাসের উপন্যাসসমগ্র সমৃদ্ধ হয়েছে ‘আমি মৃণালিনী নই’, ‘হৃদয়নদী, ‘রামগোলাম’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ইত্যাদি চমৎকার উপন্যাসের মাধ্যমে। হরিশংকর জলদাসের ছোটগল্প ‘লুচ্চা’, ‘জলদাসীর গল্প’, ‘মাকাল লতা’ প্রভৃতিও পাঠকপ্রিয়। এছাড়া দুটি আত্মজীবনী রচনা করেছেন তিনি। ‘কসবি’, ‘দহনকাল’, ‘জলপুত্র’ হরিশংকর জলদাস এর সেরা বই। মধ্যবয়সে লেখা শুরু করলেও সাহিত্যকর্মে নতুন মাত্রা যোগ করায় তিনি বহু পুরস্কার অর্জন করেছেন। ২০১১ সালে ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা পুরস্কার’ (দহনকাল), ২০১৩ সালে ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’ (জলপুত্র), ‘ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার’ (প্রতিদ্বন্দ্বী), ‘বাংলা অ্যাকাডেমি পুরষ্কার’, ‘সিটি আনন্দ আলো পুরস্কার’ সহ ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৯ সালে তিনি পেয়েছেন ‘একুশে পদক’।