ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা, ছোটো ছোটো দুঃখকথা/ নিতান্ত সহজ সরল,/ সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি/ তারি দু-চারটি অশ্রু জল।“ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ ধ্রুপদী সূত্র ধরে - অনায়াসে বলা যায়, শাবানা ইসলাম বন্যার 'অপূর্বা' শীর্ষক গল্পগ্রন্থের গল্পগুলোয় পরিচিত গণ্ডির প্রাত্যহিক ছোটো ছোটো হাসি-উচ্ছ্বাস, প্রেম-ভালোবাসা, দুঃখ-বেদনার পরিমিত, সাবলীল এবং খণ্ড খণ্ড উপাখ্যান উঠে এসেছে। শাবানা ইসলাম বন্যা কবি ও কথাসাহিত্যিক। ইতোমধ্যে তাঁর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ ও গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এবং সেগুলো ক্রমাগতভাবে পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তাঁর এসব লেখা পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠার যৌক্তিক কারণ অনুসন্ধানে গ্রন্থস্থিত গল্পগুলো কথাসাহিত্যের অন্তরঙ্গ শিল্পবৈশিষ্টের সাক্ষ্য প্রদান করে। গল্পগুলো সমসাময়িক সামাজিক জীবন থেকে তুলে আনা হয়েছে, তাই এগুলো পাঠকের কাছে তাজা, জীবন্ত এবং অকৃত্রিম মনে হবে। মনে হবে- নিজেরই কিংবা পাশেরই গল্প। পাঠকের এ বোধকে বিশ্বাসের স্তর পর্যন্ত পৌঁছে দিতেই কি শাবানা ইসলাম বন্যা গল্পের বিষয়বস্তু/ফোকাসের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট চরিত্র, ঘটনা এবং ঘটনাপ্রবাহের আর্থসামাজিক-স্থানিক চিত্র নির্মাণে সচেতন প্রজ্ঞা প্রয়োগ করেছেন? তাঁর গল্প অতিনাটকীয়তাকে এড়িয়ে, পাঠককে ঘুরেফিরে পরিচিত মুখের মুখোমুখি হতে দেয় আর এভাবেই চরিত্রগুলোর সামাজিক মুখের অন্তরালে তাদের ক্রিয়াশীল মানসচিন্তাকে পাঠকের কাছে উন্মুক্ত করে। যাপিত জীবনপথের চেনা অলিগলি ধরে যেতে যেতে নতুন কিংবা অপ্রচলিত ছোটো পথের শেষে গুরুত্বপূর্ণ মনঃস্তাত্বিক আলোর ইঙ্গিত করে তাঁর গল্প- যেখানে পাঠকের জন্য সমাজভাবনার খোরাক তৈরি হয়। রচনাশৈলী বিবেচনায় তাঁর লেখা সরল অথচ গভীর। শৈল্পিক নান্দনিকতার উপর ভর করে ছোট কিংবা সুক্ষ্ণ একটি গল্পের ভাঁজ খুলতে খুলতে কথাসাহিত্যের মহৎ প্রতিকৃতিতে কথা ও ভাবনার নিভৃত-মুকুট পরিয়েছেন তিনি। পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্যানভাসে কথার রংতুলি টানতে টানতে ফুটিয়ে তুলেছেন মানুষের মনঃস্তাত্বিক আবহ, সরল-জটিল গতিপ্রকৃতি। কথার ভেতরে কথা রেখে দিয়ে পাঠকের মানসজগতে সচ্ছন্দে উন্মোচন করেছেন না-বলা কথার পর্দা। সাহিরা, কল্পকুঞ্জ, নীলিমা ছুঁয়ে রই শীর্ষক গল্পগুলো পড়তে পড়তে পাঠক নিজ ভাবনার নিগুঢ়ে সেসব কথার প্রচ্ছন্ন খেলা প্রত্যক্ষ করবেন। অনন্য সাধারণ এ গল্পগুলোয় কিছু অপূর্ব পুরুষ চরিত্র থাকলেও অধিকাংশেই নারী চরিত্রকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ফলে আমাদের সমাজের সমসাময়িক নারী-ভাবনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ঘাত-প্রতিঘাত, ক্ষোভ ও দ্বন্দ্বের রসায়ন গল্পগুলোতে উঠে এসেছে। আর এক্ষেত্রে চরিত্র নির্মাণে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি চরিত্রের নামকরণ, স্থানিক বর্ণনা, সামাজিক আচার ও মিথঃস্ক্রিয়া প্রকাশে শাবানা ইসলাম বন্যা পরিবর্তনশীল সমাজের আবহমান সংস্কৃতি, ব্যক্তি-পারিবারিক-সামষ্টিক অভ্যাস এবং এসবের সাম্প্রতিক ঝোঁকের দিকে দৃষ্টি রেখেছেন। অধিকাংশ গল্পের নামকরণে তিনি কথাসাহিত্যে সৃজনশীল আধুনিক ভাবনার ইঙ্গিত রেখেছেন। দহনে জ্যোৎস্নাফুল, নীলিমা ছুঁয়ে রই, সাইনবোর্ড, ইত্যাদি গল্পের নামকরণ কেবলমাত্র প্রাসঙ্গিকই নয় অনেকটা অপ্রচলিত ঢঙেরও। এবং একচামচ ভালোবাসা, লোকাল বাস, অপলা, ঝরা পাপড়ি, হৃদয়ের ঋণ গল্পগুলো পাঠের পর পাঠকের মনে হবে লেখক গভীর দৃষ্টিতে জীবনকে দেখেন। মানুষের অসহায়ত্ব আর শক্তির জায়গা চিহ্নিত করেন। তার গল্প নির্মাণ প্রচেষ্টা সৃজনশীলতার গুণে স্বতন্ত্র। গল্পগুলোতে রাজনীতি, সামাজিক কৃষ্টি, অর্থনৈতিক প্রবাহ, ধর্ম, ইত্যাদি উঠে এসেছে নানাভাবে। তবে এগুলো গল্পের লক্ষ্য বা উপজীব্য হিসেবে আসেনি। বরং প্রাসঙ্গিক অনুসঙ্গ হিসেবে এসেছে। ফলে তাঁর গল্পে সমাজ, কাল এবং পরিস্থিতি পাঠকের কাছে জীবন্ত হয়ে ধরা দিতে উদ্যত। শাবানা ইসলাম বন্যা রচিত পূর্বতন কাব্যগ্রন্থ এবং গল্পগ্রন্থ গুলোর মতোই 'অপূর্বা' শীর্ষক তৃতীয় গল্পগ্রন্থটি পাঠকের ভালো লাগবে- অন্ততঃ পূর্বঅভিজ্ঞতার আলোকে আগাম এ প্রত্যাশা করাই যায়। আর এ গল্পগ্রন্থটি পাঠক ভালোবেসে হাতে তুলে নিলেই তাঁর যাবতীয় আয়োজন এবং শ্রম সার্থক হবে। আমি, লেখক শাবানা ইসলাম বন্যা এবং 'অপূর্বা' গল্পগ্রন্থের সাফল্য কামনা করছি। শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব
বছরের স্নিগ্ধতম মাস অক্টোবরের ১৫ তারিখে শাবানা ইসলাম বন্যার জন্ম। লেখকের জন্মের ঋতু শরৎ। ঐশ্বর্য, প্রাচুর্যের চেয়ে স্নিগ্ধতা, নির্মলতাকে প্রাধান্য দেন তিনি। একজন মুক্তিযোদ্ধা বাবার কন্যা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করেন। বাবা-মায়ের পঞ্চম সন্তানটির নিজের কিছু কাগুজে সন্তান রয়েছে। তিনি ইতিমধ্যে তাদের পরিচয়েও পরিচিত। ১: একমুঠোয় হৃদকথন- কাব্যগ্রন্থ ( পেন্সিল পান্ডুলিপি বিজয়ী ২০১৯ ) ২: মনপাড়ার আওয়াজ - কাব্যগ্রন্থ ( চলন্তিকা সাহিত্য পুরস্কার ২০২১) ৩: ভালোবাসার হাতকড়া -গল্পগ্রন্থ ( শিখা প্রকাশনী ২০২০) ৪: আলোর নূপুর - উপন্যাস ( সাহিত্য দিগন্ত পুরস্কার ২০২২) ৫: তিয়াসা - গল্পগ্রন্থ (গল্পগ্রন্থে চলন্তিকা বেস্টসেলার পুরস্কার ২০২২) ৬: মেঘবাড়ির জল আমি- কাব্যগ্রন্থ (কাব্যগ্রন্থে চলন্তিকা বেস্টসেলার ২০২৩) এছাড়াও আরশি নগর ফাউন্ডশন কতৃক 'ওমেন্স গ্রান্ড পার্সোনালিটি অ্যাওয়ার্ড' ২০২৩ এবং ভাষা কল্যাণ সাহিত্য পরিষদ কতৃক ২০২৩ - এ 'আলোকিত নারী'র পুরস্কার পেয়েছেন । অবসরে বইপড়া, গান শোনা এবং আবৃত্তি করা তার নেশা। বাংলাদেশ নারী লেখক সোসাইটির একজন সাহিত্য সম্পাদক তিনি। কালের কাব্যকথা- ৩ ও ৪ সম্পাদনা করেছেন। ২০২৪ এর বইমেলায় প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ "অর্পূবা"। লেখকের এটি তৃতীয় গল্পগ্রন্থ। তবে বইয়ের সংখ্যায় ৭ম। 'অর্পূবা' গল্পগ্রন্থটি পাঠকের ভালোবাসার হাতকড়ায় বন্দি হতে চায়।